ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

এবার একঘরে খোকসার সেই কৃষক পরিবার

মাতবরদের এত ক্ষমতা!

মাতবরদের এত ক্ষমতা!

মুনসী লিটন, খোকসা (কুষ্টিয়া)

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১৩:২৫

সামান্য ঘটনায় খোকসার দরিদ্র কৃষক সনজীৎ সরকারকে সালিশ ডেকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। সালিশের রায় অনুযায়ী, তাকে গাছের ডাল দিয়ে ২৫ বার আঘাতের পাশাপাশি জরিমানা করা হয় ১৫ হাজার টাকা। নির্মম সেই মারধরে সনজীতের দুই পায়ের হাড় ফেটে যায়। এখন তিনি আর একা উঠে দাঁড়াতে পারেন না। টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসাও সম্ভব হয়নি। ফলে পঙ্গু হওয়ার শঙ্কা তীব্র হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে না পারায় পরিবারটিকে এবার একঘরে করে রাখার 'রায়' দিয়েছেন মাতবররা। দ্বিতীয় দফা সালিশ বৈঠক ডেকে এ রায় ঘোষণা করা হয়। এসব রায়ের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের অবস্থান থাকলেও সালিশকারীদের ভয়ে তারা কেউ মুখ খুলছেন না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই সমকালকে বলেছেন, মাতবরদের কীসের এত প্রভাব? সামান্য ঘটনার জেরে একতরফা রায় দিয়ে একজন দরিদ্র কৃষককে এভাবে তারা মারধর করতে পারেন না। ওই অন্যায় বিচারের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন স্থানীয় লোকজন।

জানা যায়, ওই কৃষকের বাড়ি উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে। সম্প্রতি চোরের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় গ্রামটিতে পাহারা দেওয়া হয়। চোর ধরা নিয়ে গত ৫ জানুয়ারি তার সঙ্গে একই গ্রামের চোর পাহারা দলের সদস্য বিভূতি পোদ্দারের কথাকাটাকাটি হয়। এর জেরে পরদিন ধস্তাধস্তি হয়। এতে উভয় পক্ষই আহত হন। এ ঘটনায় বিভূতির পক্ষ নিয়ে গ্রামের মাতবররা সালিশ বৈঠকের উদ্যোগ নেন। ৯ জানুয়ারি গভীর রাতে গ্রামে সালিশ বসে। প্রধান মাতবর গ্রীজা ঘোষের বাড়িতে মাতবর চিত্তরঞ্জন সরকারের সভাপতিত্বে সালিশে কৃষক সনজীতের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়। জনসমক্ষে সেই রায় বাস্তবায়ন করেন চিত্তরঞ্জন সরকার। কৃষকের পরিবারের বিরোধিতার পরও সে রাতে এ রায় বাস্তবায়ন করা হয়। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েন সনজীৎ। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে পাঁচ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেও নির্যাতনের পর থেকে তিনি আর একা উঠে দাঁড়াতে পারেননি। দুই পায়ের হাঁটুর নিচের অংশের প্রধান হাড় দুটি ফেটে গেছে। পায়ের ব্যথায় আর কাজ করতে পারছেন না। অর্থাভাবে কৃষকের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

এরই মধ্যে সালিশে ধার্য করা জরিমানা ১৫ হাজার টাকা পরিশোধের জন্য তার পরিবারের ওপর চাপ দিতে থাকেন সালিশ কর্তারা। জরিমানা না পেয়ে গত রোববার রাতে দ্বিতীয় দফায় সালিশ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এবার পরিবারটিকে একঘরে করে রাখার রায় দেওয়া হয়। সালিশ কর্তারা বলছেন, হয় জরিমানা ১৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে, না হয় এই রায় বহাল থাকবে। এই রায়ের পর গতকাল সকাল থেকে গ্রামের কেউ প্রকাশ্যে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে সাহস পাচ্ছেন না। এমনকি গ্রামের লোকেরা তাদের মাঠে যেতেও বাধা দিচ্ছে।

প্রথম সালিশ বৈঠকে স্থানীয় প্রভাবশালী শ্রীকান্ত ঘোষ, হরেন রায়, কল্যাণ সরকার, কান্তিসহ মোট ৭ জন উপস্থিত ছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুল শিক্ষক বলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে অনেকে থাকলেও প্রভাবশালী মাতবরদের ভয়ে তারা মুখ খুলতে সাহস পাননি। সালিশে শারীরিক নির্যাতন চালানো ও সমাজচ্যুত করার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। আরও অনেকেই এমন মন্তব্য করেছেন।

অসুস্থ কৃষক সনজীৎ সরকার জানান, তার পরিবারকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই রাতে গ্রামের ভ্যানচালকদের হাসপাতালে যেতে দেওয়া হয়নি। তাকে চিকিৎসা করানোর কারণে তার স্ত্রী শীলা রানীকে একদিন বাড়িতে আটকে রেখেছিল মাতবরদের লোকেরা। এবার আবার তাদের একঘরে করে রাখা হলো। এতে তারা ভেঙে পড়েছেন। তারা এখন সালিশ কর্তাদের হামলার ভয়ে মাঠে যেতে পারছেন না। এ ঘটনার পর থেকে পুরো পরিবারটি আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

সালিশ কর্তা চিত্তরঞ্জন সরকার ও গ্রীজা ঘোষ কৃষক সনজীতের পরিবারকে একঘরে করে রাখার কথা স্বীকার করেন। তারা দাবি করেন, উচ্ছৃঙ্খলতার অপরাধে ওই কৃষককে মারধর করা হয়েছে। গ্রাম পাহারা দলের সদস্য বিভূতির ফোন নষ্ট করে ফেলায় ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে তারা জরিমানা দিলে সমাজে তাদের নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।

শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ খান বলেন, এ ঘটনা সাংবাদিকের মুখে তিনি প্রথম শুনলেন। এ ছাড়া এসব ব্যাপার গ্রামের মাতবরদের। এখানে তার তেমন কিছু করার থাকে না।

থানার ওসি (তদন্ত) ইদ্রিস আলী আলীও এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান। তবে তিনি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মজিবর রহমানের সঙ্গে পরে কথা বলবেন বলে জানান।

আরও পড়ুন

×