ঢাকা শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

ভাই গিরিশ চন্দ্রের স্মৃতিচিহ্ন কি হারিয়ে যাবে

ভাই গিরিশ চন্দ্রের স্মৃতিচিহ্ন কি হারিয়ে যাবে

আশাদউল্লাহ মনা, পলাশ (নরসিংদী)

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১৩:২৭

গিরিশ চন্দ্র সেন। ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন নামেই তিনি বেশি পরিচিত। তার প্রধান পরিচয় মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদক হিসেবে। শুধু কোরআন শরিফের অনুবাদ নয়, ইসলাম ধর্মবিষয়ক অনেক গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন তিনি। ইসলাম ধর্ম নিয়ে গবেষণাও করেছেন অনেক। জমিদার মাধবরাম সেন রায়ের নয় সন্তানের মধ্যে গিরিশ চন্দ্র সেন ছিলেন সবার ছোট। তার জন্ম নরসিংদীর পাঁচদোনা গ্রামে। তবে জমিদারের ছেলে হলেও তার সব সম্পত্তিই এখন বেহাত। জমিগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়ে গেছে কিংবা অবৈধ দখলে আছে। ২ দশমিক ২২ শতাংশ জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা একমাত্র বাড়িটিও সরকারি খাতায়। শুধু তাই নয়, বিশিষ্ট এই মানুষটিকেও ভুলতে বসেছে স্থানীয়রা। জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতেও কেউ তাকে স্মরণ করে না।

এর আগে বেশকিছু দিন অযত্ন-অবহেলায় ভাই গিরিশ চন্দ্রের বাড়িটি পড়ে থাকায় সরকারিভাবে এর সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গড়ে তোলা হয় ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন জাদুঘরও। এখানে তুলে রাখা হয়েছে গুণী এই মানুষটির ব্যবহূত জিনিসপত্র ও তার লেখা বই।

ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্বেষণে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ ভাই গিরিশের স্মৃতিচিহ্ন দেখতে তার বাড়িতে আসেন। খোঁজ করেন অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন। স্থানীয় অনেকেই জানান, বিখ্যাত এই মানুষটির বেশিরভাগ স্মৃতিচিহ্নই তথা সম্পত্তি অবৈধ দখলে চলে যাওয়ায় মানুষ ইতিহাস-ঐতিহ্য দর্শন ও জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের নামে বর্তমানে কোনো জমি তারা খুঁজে পাচ্ছেন না বলে সমকালকে জানান মেহেরপাড়া ইউনিয়নের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফরহাদ মিয়া। তিনি জানান, ১৯১০ সালে গিরিশ চন্দ্র সেন মারা যাওয়ার পর জমির সিএস রেকর্ড হয়। সেই সময় ভাই গিরিশের বংশের কেউ না থাকায় সব সম্পত্তি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়ে যায়। তারা অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার নামে কোনো দলিল পাননি। তবে এ মৌজায় এখনও বিআরএস জরিপ শুরু হয়নি। এবারের জরিপে ভাই গিরিশের বাড়িটি তার নামে রেকর্ড করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

ফরহাদ মিয়া আরও জানান, কিছুদিন আগে গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ির পাশে হাফিজুল্লাহ মুন্সি নামে এক ব্যক্তি এক শতাংশের মতো জমি দখলে রেখেছিল। পরে তারা তা দখলমুক্ত করে গিরিশ চন্দ্রের বর্তমানে থাকা ১.২২ শতাংশের সঙ্গে যুক্ত করে দেন।

ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৪ সালে। হিন্দু পরিবারে জন্ম হলেও তার সুনাম-সুখ্যাতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরবি-ফার্সি ভাষায় পাণ্ডিত্য। ১৮৭১ সালে তিনি ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। ১৮৭৬ সালে ৪২ বছর বয়সে তিনি মৌলভী এহসান আলীর কাছে আরবি ব্যাকরণ শেখেন। তিন বছর কঠোর সাধনার পর গিরিশ চন্দ্র সেনই সর্বপ্রথম ১৮৮১ সালে পবিত্র কোরআন শরিফের প্রথম পারা বাংলা অনুবাদ করেন, যা শেরপুর চারু চন্দ্র প্রেস থেকে ছাপা হয়। পরে আরও তিন বছর কঠোর পরিশ্রম করে ১৮৮৪ সালে তিনি সম্পূর্ণ কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেন। তার প্রকাশিত ৩৫টি গ্রন্থের মধ্যে ২২টিই ইসলাম ধর্মবিষয়ক। ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন ১৯১০ সালের ১৪ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরে পাঁচদোনা গ্রামের বাড়িতেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সংস্কারের অভাব আর দখলদারিত্বের কারণে প্রাচীন ওই বাড়িটি তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছিল। ২০০৮ সালে বাড়িটির মূল কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে সংস্কারে অনুদান দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশে তৎকালীন ভারতের হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। পরে ২০১৫ সালে নরসিংদী জেলা প্রশাসন ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণের মধ্যে বাড়িটি সংরক্ষণ ও একটি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর নির্মাণের চুক্তি হয়। এরপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও দিকনির্দেশনায় ২০১৭ সালে এর সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে এক কোটি ২০ লাখ টাকা অনুদানও পায় ঐতিহ্য অন্বেষণ। চুক্তিনামা অনুযায়ী কাগজপত্রে গিরিশ চন্দ্রের নাম উল্লেখ আছে।

বিশিষ্ট এই মানুষের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী সরকারি-বেসরকারিভাবে পালন না করায় অসন্তোষ রয়েছে স্থানীয়দের। তাকে নিয়মিত স্মরণ করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

জানা যায়, ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন ১৮৫৬ সালে বর্তমান পলাশ উপজেলার বাগপাড়া গ্রামের জয়কালী দেবী নামে এক জমিদারের মেয়েকে বিয়ে করেন। ১৮৬৯ সালে তাদের একটি মেয়ে হলেও ১৪ দিনের মাথায় মারা যায়। এরপর এক বছরের ব্যবধানে স্ত্রী জয়কালী দেবীও মারা গেলে আর বিয়ে করেননি ভাই গিরিশ চন্দ্র। ফলে তিনি আর উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেননি। জমিদারের সন্তান হিসেবে গ্রামের বাড়িতে প্রচুর জায়গা-জমি থাকলেও তার মৃত্যুর পর সেসব সম্পত্তি বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে চলে গেছে।

সরেজমিন জানা যায়, বর্তমানে বাড়িটি দেখভাল করছেন ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন জাদুঘরের পরিচালক কাউছারুল হক কানন। তিনি জানান, বর্তমানে বাড়িটি ছাড়া ভাই গিরিশ চন্দ্রের বাকি সম্পত্তির কোনো হদিস নেই। সরকার যদি বেদখল হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করে দেয়, তাহলে বাড়িটির পাশে কিছু জায়গা সম্প্রসারিত করে সেখানে গিরিশ চন্দ্র সেন নামে একটি লাইব্রেরি, বাড়ির প্রধান ফটকসহ সীমানা প্রাচীর এবং আরও কিছু প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যেত।

আরও পড়ুন

×