ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

বদলে যাচ্ছে মহেশখালী

বদলে যাচ্ছে মহেশখালী

আবু তাহের, কক্সবাজার

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১৩:৩১

তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র বুলবুল আহমদ। পড়ছে আদিনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর এই শিক্ষার্থী এখন ঢাকার অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠ নেয়। দূরশিক্ষণের মাধ্যমে নিজ বিদ্যালয়ে বসেই বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠ নিচ্ছে সে। জাগো ফাউন্ডেশনের জাগো ডিজিটাল স্কুলের শিক্ষক ফারিহা আহমদ ঢাকায় থেকেই সরাসরি মহেশখালী দ্বীপের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়াচ্ছেন। বুলবুলের মতো তাসনিয়া, শিখা, জুয়েলসহ বিদ্যালয়টির অন্য শিক্ষার্থীরাও খুশি দূরশিক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে শিখতে পেরে।

ছোট-বড় তিনটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত মহেশখালী। একটি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে এ উপজেলা অনেকটা দুর্গম এলাকা। দ্বীপের উত্তর প্রান্ত কালারমারছড়া থেকে তিন বছরের শিশুসন্তানকে নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে এসেছেন আনোয়ারা বেগম। তার মেয়ে চর্ম রোগে আক্রান্ত। কিন্তু উপজেলা হাসপাতালে নেই এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক। হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শিব শেখর ভট্টাচার্য ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। আনোয়ারার মেয়ের চর্ম রোগের ব্যবস্থাপত্র দিলেন। আনোয়ারার মতো দ্বীপের আরও অনেককে জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য এখন আর দূরে যেতে হচ্ছে না। দ্বীপে বসেই ডিজিটাল মাধ্যমের সুবিধা নিয়ে ঢাকার বা অন্য কোনো শহরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখাতে পারছেন।

মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপে শুধু পড়ালেখা নিয়েই বসে থাকেননি তরুণ-তরুণী ও শিক্ষার্থীরা। কিংবা দ্বীপের বাসিন্দারা শুধু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাচ্ছেন এমন নয়। ডিজিটাল মাধ্যমের সুযোগ নিয়ে অনেকেই এখন যুক্ত হয়েছেন ব্যবসায়। নিজেদের গড়ে তুলছেন উদীয়মান 'উদ্যোক্তা' হিসেবে। তাদেরই একজন মারুফা আকতার। তারা ৯ বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছেন অনলাইনে বিষমুক্ত শুঁটকি বিক্রির প্রতিষ্ঠান 'ই-বিজনেস সেন্টার'। ই-কমার্সের মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তে গ্রাহকের কাছে বিষমুক্ত শুঁটকি মাছ পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করছে দেশের অন্যতম বৃহৎ অনলাইন প্রতিষ্ঠান 'দারাজ'। মহেশখালীতে বেড়াতে আসা পর্যটকরাও তাদের কাছ থেকে শুঁটকি কিনছেন।

এভাবেই বদলে যাচ্ছে প্রত্যন্ত দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী। আর এটি সম্ভব হয়েছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। মহেশখালীকে ঘোষণা করা হয়েছে 'ডিজিটাল আইল্যান্ড'। গত সোমবার এখানকার বিভিন্ন ই-সেবা কেন্দ্র, ই-কমার্স সেন্টার এবং ডিজিটাল স্কুল পরিদর্শন করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। বর্তমান সরকার তথ্যপ্রযুক্তির সেবা গ্রামের তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে যে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করেছে, মহেশখালী দ্বীপও তার আওতায় এসেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা এখানকার জনগোষ্ঠীকে উন্নত চিকিৎসা ও শিক্ষা গ্রহণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহেশখালীকে 'ডিজিটাল আইল্যান্ড' ঘোষণা করেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম মহেশখালী ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সঙ্গে যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে আইওএম ও কোরিয়া টেলিকম।

আইওএমের ট্রানজিশন অ্যান্ড রিকভারি ডিভিশনের প্রধান প্যাট্রিক শেরিগনন জানান, মহেশখালী দ্বীপটি বাংলাদেশের স্বল্প-উন্নত জনগোষ্ঠীর একটি এলাকা। এখানে নিরক্ষরতার হার বেশি। মাটির লবণাক্ততা কৃষি ফলনকে বাধাগ্রস্ত করে। স্থানীয় যুবসমাজ জীবিকার তাগিদে দ্বীপ থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হচ্ছে। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এ দ্বীপের ভবিষ্যৎ। তিনি জানান, ডিজিটাল দ্বীপ প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বিদ্যমান জনসুবিধাদির আরও প্রসার ঘটিয়ে মহেশখালীর বাসিন্দাদের জন্য সুযোগ তৈরি করা। প্রকল্পটির কারণে এখানকার বাসিন্দারা ১০০ এমবিপিএস গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছেন।

মহেশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জামিরুল ইসলাম জানান, ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটির মাধ্যমে মহেশখালীতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। টেলিমেডিসিন, দূরশিক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তি ও কমিউনিটি ক্লাবের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছেন মানুষ। দ্রুতগতির ইন্টারনেটের কল্যাণে উপজেলা প্রশাসন ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে ৮০ শতাংশ দাপ্তরিক কাজ করছে। ইউএনও জানান, কীটনাশক ও সংরক্ষণকারী রাসায়নিক উপকরণের ব্যবহার কমিয়ে স্থানীয়দের জৈব কৃষি এবং অর্গানিক পদ্ধতিতে মাছ শুকাতে উৎসাহিত করছে এ প্রকল্প। পাশপাশি ই-কমার্সের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে আয় বাড়ানো ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য দূর করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

এই ডিজিটাল দ্বীপের সুবিধাভোগীরা জানান, এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫টি স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে আরও নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ই-শিক্ষার মাধ্যমে স্থানীয় শিক্ষকদের সক্ষমতা বেড়েছে।

জাগো ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মহেশখালীর ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দূরশিক্ষণ পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় রাজধানী ঢাকার শিক্ষকরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মহেশখালী দ্বীপের শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক পাঠ দেন। আদিনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনিয়া জানায়, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পড়া শিখে আনন্দ পাচ্ছে। নতুন নতুন অনেক কিছু শিখতে পারছে।

মহেশখালীর চারটি কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক এবং একটি উপজেলা হাসপাতালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় স্বাস্থ্যগত রেকর্ড সিস্টেম, টেলিমেডিসিন পরামর্শ, মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে রোগ নির্ণয়। স্থানীয় ও সরকারি কর্মকর্তাদের কম্পিউটার দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে আইওএমের ডিজিটাল সেন্টারে।

মহেশখালী পৌরসভার মেয়র মকছুদ মিয়া বলেন, ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পের মাধ্যমে মহেশখালীবাসী অনেক সুফল পাচ্ছেন। সব ইউনিয়নে একসঙ্গে কাজ শুরু করা গেলে পুরোপুরি সাফল্য পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন

×