সহাবস্থানের নতুন বার্তা চট্টগ্রামের গণসমাবেশ
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২২ | ১৪:০৩
উৎসবমুখর মঞ্চ, স্লোগানের মুখরতা, বিপুল জনসমাগম- এ সবকিছু যেন ভুলতেই বসেছিল রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। অন্তত ১০ বছর পর পলোগ্রাউন্ড মাঠে চট্টগ্রাম বিএনপি ফের শক্তির জানান দিল। এক গণসমাবেশের মহিমায় বোতলবন্দি হয়ে থাকা দলটির নেতাকর্মী যেন পেয়েছে নব উদ্যম। বিএনপির এত বড় কর্মসূচিতে বাধা না দিয়ে আওয়ামী লীগও দিয়েছে সহাবস্থানের নতুন বার্তা। প্রধান দুই দলের এমন সহনশীল চরিত্রে নতুন করে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে বন্দরনগরীর রাজনীতি।
শান্তিপূর্ণ এ সহাবস্থান ধরে রেখে উভয় দলকে এখন সাংগঠনিক ভিত মজবুত করার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা। তাঁরা বলছেন, ভুল শুধরে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছে এই সমাবেশ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরী বলেন, 'দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি পছন্দ করে না কেউই। রাজনৈতিক দলগুলো এটা যত বেশি উপলব্ধি করতে পারবে, ততই বাড়বে তাদের জনসম্পৃক্ততা। চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ একটি গণসমাবেশ করেছে বিএনপি। তার মানে, চাইলে সব সমাবেশই শান্তিপূর্ণ করা সম্ভব। এই চাওয়াটা হতে হবে দ্বিপক্ষীয়। থাকতে হবে সবাইকে আন্তরিক।'
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, 'ভোটের এখনও অনেক দিন বাকি থাকলেও এমন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি রাজনীতির মাঠে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। এটিকে টেনে নিতে হবে সারাদেশে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি যারা করে, তাদের জন্য এটা নতুন এক বার্তা। শান্তি স্থাপনে বিরোধী দলে যাঁরা আছেন, তাঁদের যেমন দায়িত্ব আছে; তেমনি আছে ক্ষমতাসীন দলেরও।'
চাঙ্গা বিএনপি :গণসমাবেশ সফল হওয়ার পর এখন অনেকটাই চাঙ্গা ১০ সাংগঠনিক জেলা নিয়ে গঠিত বিএনপির চট্টগ্রাম সাংগঠনিক বিভাগ। চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা ছাড়াও সাংগঠনিক জেলার মধ্যে রয়েছে- রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষীপুর। গণসমাবেশের আগে সবক'টি সাংগঠনিক জেলার সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রস্তু্তুতি সভা করে বিএনপি। আবার জেলা-উপজেলা পর্যায়েও প্রস্তু্তুতি সভা করা হয়। এসব সভায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নিয়ে সমাবেশ সফল করতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ফলে ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীরা এখন সরব।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, 'চট্টগ্রাম দিয়ে গণসমাবেশের কার্যক্রম শুরু করেছে বিএনপি। এটি শেষ হবে রাজধানী ঢাকা দিয়ে। চট্টগ্রাম নানা কারণে বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক অঞ্চল। দলের অবস্থানও এখানে তুলনামূলক ভালো। এ কারণে চট্টগ্রামে সমাবেশ করে শুরুতেই চমক দিতে চেয়েছে দল। আমাদের নেতাকর্মী সব বাধা উপেক্ষা করে এখানকার মহাসমাবেশ সফল করে দিয়েছে। এর প্রভাব পড়বে এখন পরের সমাবেশগুলোতে। সরকার বাধা না দিলে বিভাগীয় সব গণসমাবেশ হবে জনসমুদ্র।'
চট্টগ্রামের গণসমাবেশে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, 'আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার চট্টগ্রাম থেকে এবারও আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করা হয়েছে। গণসমাবেশের পর পুরো বিভাগে গণজোয়ার তৈরি করেছে।'
প্রস্তুত আওয়ামী লীগও :বিএনপির গণসমাবেশ সফল হওয়ায় নতুন করে ভাবছে আওয়ামী লীগও। আরও বড় পরিসরে মহাসমাবেশ করতে প্রস্তুতি শুরু করেছে তারা। এ জন্য দলের সাংগঠনিক ভিত্তি আগে মজবুত করবে দলটি। যুবলীগ ও ছাত্রলীগকে করবে ঐক্যবদ্ধ। নগর কমিটি নিয়ে যে কাজ চলমান, সেটিও দ্রুত শেষ করতে চাই তারা। এর পর চট্টগ্রামে বিএনপির চেয়ে আরও বড় পরিসরে মহাসমাবেশ করবে তারা। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে হওয়া টানেল উদ্বোধন হতে পারে ডিসেম্বরে। ওই অনুষ্ঠান ঘিরে জনসমাগম বাড়ানো যায় কিনা, তা নিয়ে ভাবছে আওয়ামী লীগ।
চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, 'বিএনপি চাইলে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি হয়। তারা চাইলে জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতিও হয়। এখন কোনটি তারা বেছে নেবে- সেই সিদ্ধান্ত তাদের। আওয়ামী লীগ কখনোই তাদের কর্মসূচিতে বাধা দেয়নি; ভবিষ্যতেও দেবে না।' চট্টগ্রামে বড় সমাবেশ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমরা ডাক দিলে এর চেয়ে দশ গুণ মানুষ নিয়ে জনসভা করতে পারি। সময় হলে চট্টগ্রামে সেটিও করে দেখাব। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমাদের নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই।'
পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনে উত্তাপ :গণসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও কর্মসূচি পালনের আগে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল আওয়ামী লীগ-বিএনপি। বিভাগীয় সমাবেশের নামে বিএনপি যদি কোনো ধরনের সহিংসতার চেষ্টা করে এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়, তাহলে তাদের শক্ত হাতে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে গত ১০ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা।
আওয়ামী লীগের সেই বক্তব্যের জবাব দিতে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি। সেখানে বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, লাঠিসোটা, চায়নিজ রাইফেলের চেয়েও শক্তিশালী জনগণ। বিএনপির সঙ্গে সেই জনগণ আছে। আর যারা জনবিচ্ছিন্ন, তারাই প্রতিরোধের কথা বলছে। তবে মানুষ কোনো প্রতিরোধই মানবে না।
- বিষয় :
- চট্টগ্রামের গণসমাবেশ
- রাজনীতির সমীকরণ