রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অপেক্ষায় যুদ্ধশিশু মেরিনা খাতুন
মোছা. মেরিনা খাতুন
এম. আতিকুল ইসলাম বুলবুল তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ)
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১৩:৪৫
সিরাজগঞ্জের তাড়াশের '৭১-এর যুদ্ধশিশু মোছা. মেরিনা খাতুন তাঁর সংশোধন করা জাতীয় পরিচয়পত্র গত ৪ সেপ্টেম্বর হাতে পেয়েছেন। যেখানে তাঁর জন্মতারিখ ৬ জুন ১৯৭২ সাল। তাতে পিতার নাম লেখা হয়েছে অজ্ঞাত। কারণ তিনি একাত্তরের যুদ্ধশিশু। এর আগে তাঁর প্রথম জাতীয় পরিচয়পত্রে পিতার নামের জায়গায় মায়ের প্রয়াত স্বামী ফাজিল আকন্দের নাম লেখা ছিল। এখন সংশোধন করা জাতীয় পরিচয়পত্রে যুদ্ধশিশু হিসেবে নির্মম সত্য পিতা অজ্ঞাত লেখা হয়েছে।
যা যুদ্ধশিশু হিসেবে দেশে প্রথম পরিচয়পত্র হতে পারে বলে জানান তাড়াশ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুমার রায়। তিনি আরও বলেন, দেশে এতিম-অনাথদের ক্ষেত্রে কিছু জাতীয় পরিচয়পত্রে পিতার নাম অজ্ঞাত লেখা থাকলেও যুদ্ধশিশুর ক্ষেত্রে তা ছিল না। হয়তো এটাই প্রথম হতে পারে।
এদিকে, যুদ্ধশিশুদের পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)।
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকায় জামুকার চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। শিগগির মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্নিষ্টদের কাছে এই সুপারিশ পাঠানো হবে।
গত ২০১৮ সালে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ পৌর সদরের উত্তরপাড়ার প্রয়াত মা বীরাঙ্গনা পচি বেওয়ার মেয়ে ও বর্তমানে একই পাড়ার ওমর আলীর স্ত্রী মোছা. মেরিনা খাতুন তাড়াশ উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে পিতার নাম সংশোধনের জন্য আবেদন করেন। পরে টানা প্রায় দুই বছর চেষ্টা-তদবিরের পর সফল হন তিনি। অবশ্য এ কাজে যুদ্ধশিশু মেরিনাকে সহযোগিতা করেন, তাড়াশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আরশেদুল ইসলাম, ৭১ টিভির সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি মাসুদ পারভেজ ও তাড়াশ প্রেস ক্লাবের সভাপতি প্রভাষক সনাতন দাশ।
মূলত, পিতা অজ্ঞাত এই নির্মম সত্যটি তাড়াশের যুদ্ধশিশু মেরিনা খাতুনকে প্রায় ৫০ বছর ভুগিয়েছে, এখনও ভোগাচ্ছে। তাই তিনি যন্ত্রণা মুছতে এখন চাচ্ছেন সন্মানজনক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। মেরিনা খাতুন বলেন, যুদ্ধশিশু হয়ে জন্ম নেওয়া পাপ নয়। বরং আমিও '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের একটা জীবন্ত অংশ। এ জন্যই চাই মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সম্মান ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
২০১৮ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া পচি বেওয়াকে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় স্থানীয় রাজাকাররা জোর করে ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। আর সেখানেই তিনি দিনের পর দিন পাকিস্তানি সেনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। পরে তিনি (বিধবা হলেও) অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন এবং ১৯৭২ সালের ৬ জুন যুদ্ধশিশু মেরিনাকে জন্ম দেন।
মেরিনা খাতুন আরও জানান, বড় হয়ে তাঁর মায়ের কাছ থেকে জেনেছেন, ১৯৭১ সালের বীরাঙ্গনা মা পচি বেওয়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনে তাঁকে জন্ম দিলে সমাজের কিছু মানুষের বিদ্রুপ ও নানা বেদনাদায়ক তিরস্কারে জর্জরিত হয়েছিলেন। সে সময়ে তিনি পিতৃপরিচয়হীন আমাকে পেটে ধারণ করে সামাজিকভাবে যারপর নাই হেয় প্রতিপন্ন হন। আর বর্তমানে যুদ্ধশিশু হিসেবে আমিও মায়ের মতোই অসহনীয় যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত জীবন-জীবিকা নিয়ে যুদ্ধ করছি। বর্তমানে আমার ১০ সদস্যের অভাব-অনটনের সংসারে স্বামীর একটি অটোভ্যান আর ছেলের চা বিক্রির টাকায় কোনোমতে চলেছে। তাই আমি চাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মায়ের মতো রাষ্ট্রীয় সন্মানজনক মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও সুবিধা।
আর ১৯৭১ সালের চলনবিলের যুদ্ধকালীন সংগঠন পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাড়াশের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক সাইদুর রহমান সাজু জানান, যুদ্ধশিশু মেরিনার জীবন যেন '৭১-এর যুদ্ধের গল্পের মতোই করুণ। কেননা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্থানীয় রাজাকাররা তাড়াশের উত্তর পাড়ার মৃত ফাজিল আকন্দের বিধবা স্ত্রী পচি বেওয়াকে বাড়ি থেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক ক্যাম্পে পাশবিক নির্যাতনের ফলে জন্ম হয় যুদ্ধশিশু মেরিনা খাতুনের। এর চেয়ে আর নির্মম কী হতে পারে? পরে মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৮৪ সালে তাড়াশের ওমর আলীর সঙ্গে কিশোরী যুদ্ধশিশু মেরিনা খাতুনের বিয়ে হয়। বর্তমানে তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ের মা। আর ২০০৫ সালে বীরাঙ্গনা পচি বেওয়া মারা যান।
এ প্রসঙ্গে তাড়াশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আরশেদুল ইসলাম জানান, যুদ্ধশিশু মেরিনার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্যও আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে তাকে তাড়াশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা সব ধরনের সহযোগিতা করবে।