ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব

‘এহুন খামু কী, আবাদই বা করমু কী দিয়া?’

‘এহুন খামু কী, আবাদই বা করমু কী দিয়া?’

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ভারি বৃষ্টিতে ডুবে আছে ক্ষেত। গত বুধবার গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ইউনিয়নের জিতু মাতুব্বার এলাকা-সমকাল

আজু শিকদার, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী)

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ২২:৫৩

'এতা-ক্যাতা (সর্বস্ব) বেইচা বিগা দেড়েক ক্ষ্যাতে পেঁয়াজ লাগাইচিলাম, হেরপরও পইরেতের (কৃষি শ্রমিক) দাম দিবার না পাইরে ঘরে কয়ডা খাওয়ার ধান আছিল, তাও বেইচা পইরেতের দাম দিছিলাম। দেওয়ার (বৃষ্টি) পানিতে হেই ক্ষ্যাত তলাইয়া গেছে। আমাগো সব শ্যাষ অইয়া গেছে। এহুন খামু কী? ফের আবাদই বা করমু কী দিয়া?'

এভাবেই হতাশা প্রকাশ করছিলেন গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের জিতু মাতুব্বারের পাড়া গ্রামের আবদুল খালেকের স্ত্রী কৃষানি আলেয়া বেগম। তাঁর মতো অনেক কৃষকের একই অবস্থা।

জানা যায়, গত সপ্তাহে শীতের সবজি ও পেঁয়াজ আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন পদ্মাপাড়ের গোয়ালন্দের কৃষকরা। পরিবারের নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে ছোট্ট শিশুটিও ক্ষেতে নেমে পড়েছিল। পরিবারের সবাই ক্ষেতে একত্রে কাজ করার সময় তাঁদের চোখ-মুখ ছিল আনন্দে উজ্জ্বল। তবে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং তাঁদের সেই আনন্দকে বেদনায় রূপ দিয়েছে। টানা বর্ষণে তাঁদের সেই ক্ষেতে পানি জমে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তাঁদের মনে শুধুই হতাশা।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গত রোববার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে। হঠাৎ অতি বৃষ্টির ফলে মুড়িকাটা পেঁয়াজসহ বিভিন্ন শীতকালীন সবজি ক্ষেতে জমেছে পানি। কিছু কিছু ক্ষেত পুরোপুরি পানির নিচে। এতে অনেক কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। অতি বৃষ্টির ফলে কৃষকের স্বপ্ন পানির নিচে চাপা পড়ে গেছে। অনেক কৃষক ক্ষেতের পানি সেচে ফসল রক্ষার নিষ্ম্ফল চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে রোপিত বীজ পচে গেছে, তাই শেষ রক্ষা হবে না বলে জানান চাষিরা।

গত বুধবার উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের হাবিল মণ্ডলের পাড়া ও দৌলতদিয়া ইউনিয়নের জিতু মাতুব্বার পাড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিঘার পর বিঘা সবজিক্ষেত, মুড়িকাটা পেঁয়াজক্ষেত ও বীজতলায় পানি জমে আছে। দু'দিনের পানিতে কোনো কোনো জমির সবজির চারা মরতে শুরু করেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বলছেন, টানা বৃষ্টিতে শুধু তাঁরাই সর্বস্বান্ত হননি, ক্রেতাদেরও এর জের টানতে হবে। নতুন করে বীজতলা তৈরি এবং সবজির চারা রোপণের পর তা বাজারে আসতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দেরি হবে। ততদিন বাজারে সবজির দামও অনেক বেশি থাকবে। এ ছাড়া নতুন করে আবার আবাদ করায় উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে যাবে।

কথা হয় স্থানীয় কৃষক বাচ্চু শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'কী করব কিছুই মাথায় আসছে না। প্রায় সাড়ে চার বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলাম। টানা বৃষ্টিতে পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে।' তিনি আরও জানান, কৃষি ব্যাংক থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পেঁয়াজ রোপণ করেছিলেন। আবার কীভাবে আবাদ করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

অপর কৃষক আবদুল কুদ্দুস শেখ জানান, 'একটি বাড়ি একটি খামার' নামে সরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ২ বিঘা জমিতে মিষ্টিকুমড়ার আবাদ করেছিলেন। ক্ষেতে বৃষ্টির পানি জমে আছে। ইতোমধ্যে কুমড়া গাছগুলো মরতে শুরু করেছে। এরপরও গামলা দিয়ে পানি সেচে শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

আরেক কৃষক নাসির সরদার জানান, ধারদেনা করে সোয়া বিঘা জমিতে লাউ ও লালশাক চাষ করেছিলেন। জমিতে এখন হাঁটুপানি। চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলছিলেন, 'বৃষ্টি সব শেষ কইরা দিল। নতুন করে আবাদ করব সে সামর্থ্যও নাই।'

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে রাজবাড়ী জেলায় বিভিন্ন সবজিক্ষেত ১ হাজার ১৭৪ হেক্টর, মুড়ি পেঁয়াজ ২৪৬ হেক্টর, মাষকলাই ১১০ হেক্টর ও রোপা আমনের ৭ হাজার ২৮২ হেক্টর জমি বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে। গোয়ালন্দ উপজেলায় মোট ১ হাজার ২৯৫ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবজি চাষ করা হয়েছিল ৫৫০ হেক্টর, পেঁয়াজ ১১০ হেক্টর, মাষকলাই ১১০ হেক্টর, কলা ২০ হেক্টর, রোপা আমন ৫০০ হেক্টর, নাবি পাটবীজ ১ হেক্টর ও মুগডাল ৪ হেক্টর জমিতে।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×