কৌশলে পুকুর-দিঘি গিলছে সিসিক

সংস্কারের নামে ছোট করে ফেলা হচ্ছে সিলেটের কাজীদিঘি। গত বুধবার তোলা ছবি - ইউসুফ আলী
চয়ন চৌধুরী, সিলেট
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ২৩:৪২ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ২৩:৪৩
এক সময় সিলেট নগরীতে অসংখ্য ছোট-বড় পুকুর ছিল, দিঘি ছিল। এসবের নামে নগরীর বিভিন্ন এলাকার নামকরণও হয়। নগরায়ণের ফলে এলাকার নাম থাকলেও সেই পুকুর-দিঘির সিংহভাগই ভরাট হয়ে গেছে, নির্মাণ করা হয়েছে বাসাবাড়ি। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে রামের দিঘি, লালদিঘি, মাছুদিঘি, সাগরদিঘি, চারাদিঘি নামের সঙ্গে 'পাড়' যুক্ত হয়ে নগরীতে এলাকার নামগুলো শুধু টিকে আছে। নগরীতে বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি পুকুর-দিঘি বেঁচে থাকলেও সেগুলো দখল-দূষণে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এবারে কৌশলে পুকুর গিলে খাওয়ার মিশনে নেমেছে খোদ সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।
সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক প্রশস্তকরণ ও সংস্কারের আড়ালে নগরীর কাজীটুলার কাজীদিঘি ও জিন্দাবাজারে কাস্টমস অফিসের পুকুরের আয়তন কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। মাত্র তিন বছর আগে পরিবেশ রক্ষাসহ মুখরোচক নানা কথা বলে কাজীদিঘি রক্ষায় চারপাশে গার্ডওয়াল নির্মাণ করেছিল সিসিক। এবার সেই গার্ডওয়াল ভেঙে দিঘির চারদিকের রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য অন্তত ৮-১০ ফুট করে জায়গা মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলেছে। হজরত কাজী জালাল উদ্দিনের (রহ.) নামের এই ঐতিহ্যবাহী দিঘি এখন পরিণত হয়েছে মাঝারি আয়তনের পুকুরে। অথচ এই দিঘির চারপাশের বাসাবাড়ি ছাড়া অন্যদের কোনো কাজে লাগে না রাস্তাটি।
নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেন সজীব বলেন, ১৮ বছর পর কাজীদিঘি রক্ষায় চারদিকে গার্ডওয়াল নির্মাণ করেছিলাম। সব মিলে ১১০ শতক জায়গা নিয়ে এই দিঘি নির্মিত হয়েছিল। বিভিন্ন সময় দখলের ফলে তা ৮৭ শতকে নেমে আসে। এ অবস্থায় দিঘিটি রক্ষার জন্য সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে গার্ডওয়াল নির্মাণ করেছিলাম। এখন আবার রাস্তার জন্য নতুন করে জায়গা নেওয়ায় স্বভাবতই পুকুরের আয়তন কমেছে। এই পুকুরের চারদিকের রাস্তা বড় করার তেমন প্রয়োজন ছিল না। যেহেতু আশপাশের বাসাবাড়ির লোকজন ছাড়া আর কেউ তা ব্যবহার করে না।
একইভাবে সৌন্দর্যবর্ধন করে চারদিকে ওয়াকওয়ে নির্মাণের কথা বলে নগরীর জিন্দাবাজারে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অফিসের মালিকানাধীন জায়গার পুকুরের আয়তন কমাতে পাইলিংয়ের কাজ চলছে। সিসিকের উদ্যোগে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগের অংশ হিসেবে পুকুরের চারদিকে ১০-১২ ফুট করে জায়গায় পাইলিং চলছে। পুকুরের চারদিকে গার্ডওয়াল ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করতে বেশ কয়েকটি গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। সিসিক কর্তৃপক্ষ এই কাজ করছে বলে নিশ্চিত করেছেন কাস্টমস বিভাগের সহকারী কমিশনার আহমেদুর রেজা। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জরুরি মিটিংয়ে থাকার কথা বলে তিনি আর বিস্তারিত বলেননি।
এদিকে পুকুরের আয়তন কমার পাশাপাশি পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাতে সিসিকের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারের একমাত্র জলাধার আয়তনে ছোট করায় জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে। দুই বছর আগে নগরীর ঐতিহ্যবাহী ধোপাদিঘি সংস্কার করে চারপাশ রক্ষার কথা বলেছিল সিসিক। ভারত সরকারের অর্থায়নে পুকুর সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধনের কথাও বলেছিলেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এজন্য পুকুরপাড়ের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হলে নগরবাসী আশান্বিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সংস্কার কাজ শুরু না করে উল্টো পুকুরের পাড়ে ৬ তলাবিশিষ্ট মার্কেট করার পরিকল্পনা নিয়ে সাইনবোর্ডও টানিয়ে দিয়েছে সিসিক।
নগরীর সোনারপাড়ার পুকুর সংস্কারের কথা বলে বছরখানেক আগে সিসিক গার্ডওয়াল নির্মাণ করেছিল। সেই পুকুরের আয়তনও কমানো হয়েছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। সম্প্রতি সোনারপাড়ার সেই পুকুর খনন করতে গেলে গার্ডওয়াল ধসে পড়লে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। এ অবস্থায় মেয়র তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বললেও তাতে কোনো অগ্রগতি নেই। সব মিলিয়ে সিসিক কর্তৃপক্ষ নগরীর পুকুর রক্ষা ও সংস্কারের নামে কৌশলে এগুলোর আয়তন ছোট করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন পরিবেশবাদী ও সাধারণ নাগরিকরা। যে দু'একটি পুকুর রক্ষার কথা বলে গার্ডওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে নিম্নমানের কাজ করে মোটা অঙ্কের বিল তুলে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। নগরীর মজুমদারদিঘিও হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবীর বলেন, 'সিলেট সিটি করপোরেশন ও মেয়র বিভিন্ন সময়ে নগরীর পুকুর সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের কথা বলেছেন। এনিয়ে আমরা আশাবাদী হলেও বাস্তবে ভিন্নচিত্র দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গার্ডওয়াল বা ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য পুকুরের আয়তন কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে বর্ষা মৌসুমে সংশ্নিষ্ট এলাকায় বৃষ্টির পানি যাওয়ার জায়গা কমবে বলে জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, উন্নয়নের মানে শুধু রাস্তাঘাট বা অবকাঠামো নির্মাণ নয়। সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নগরীর জলাধার রক্ষা করতে হবে; গাছপালা কাটা বন্ধ করতে হবে, তাতেই পরিবেশ সুস্থ থাকবে।
উন্নয়ন করতে গিয়ে পুকুরগুলোর আয়তন সামান্য কমেছে বলে স্বীকার করেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, কাজীদিঘিতে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করতে হলে রাস্তা কাটতে হতো। রাস্তা যাতে ছোট না হয়, এজন্য পুকুরের কিছু জায়গা কমেছে। এতে ভবিষ্যতে আর কেউ পুকুরটি দখল করতে পারবে না। একইভাবে কাস্টমসের পুকুরের আয়তনও কমছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে ধোপাদিঘি মজাপুকুরে পরিণত হয়েছিল। ভারত সরকারের অর্থায়নে দখলকৃত জায়গা উদ্ধার করে তা সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খননের সময় গার্ডওয়ালের নিচ থেকে মাটি সরানোয় সোনারপাড়ার পুকুরের গার্ডওয়াল ধসে পড়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
- বিষয় :
- জলাশয় ভরাট
- জলাশয় দখল