পড়ালেখা ছাড়ছেন আছিয়া খাতুনরা

তানজীম আহমেদ, বাগেরহাট
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ০০:০০
মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর। দুপুর গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা ৩টা ছুঁই ছুঁই। বাগেরহাট সদরের যদুনাথ স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঠিক সামনে বিমর্ষ মুখে বসে আছেন এক ঝালমুড়ি বিক্রেতা। নাম সোহেল হাওলাদার (৩৪)। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানালেন কষ্টের কথা। কণ্ঠে হতাশা- 'বাজার থেকে ছেলেমেয়ের বই-খাতা-কলম নাকি খাবার কিনব ভেবে কূল পাই না।'
শারীরিক প্রতিবন্ধী সোহেল বলেন, দিনে ঝালমুড়ি বিক্রি করে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়। মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। অঙ্কে খুব ভালো। সব সময় অঙ্ক করতে চায়। আগে সপ্তাহে একটি করে খাতা কিনে দিতেন। সেই খাতা এখন প্রায় দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে। ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার লেখাপড়া চালাতেও অনেক খরচ হয়। ৫০ টাকার খাতা যদি ৮০-৯০ টাকা হয় তাহলে লেখাপড়া করাবেন কীভাবে। সব জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে দু-মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করাই কঠিন, ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করানো এখন বিলাসিতা মনে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ওদের পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
সোহেলের চেয়েও করুণ অবস্থা বিদ্যালয়টিতে চুক্তিতে নিযুক্ত আয়া লিপি সুলতানার। মাত্র ৪ হাজার টাকা বেতনে সংসারের ঘানি টানছেন তিনি। দুই ছেলে, এক মেয়ের লেখাপড়া, সংসারের খরচ, অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা- সব কিছু সামলাতে হয় তাঁকে।
লিপি সুলতানা বলেন, তাঁর বেতনের অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলে। মানুষের বাড়ি বাড়িও কাজ করেন একটু আয়ের আশায়। বড় মেয়ে লামিয়া ইসলাম যদুনাথ স্কুলের অস্টম শ্রেণির ফার্স্ট গার্ল। দুই ছেলে তামজীদ ও তাজীমও পড়ালেখায় ভালো। তাদের জন্য মানুষের কাছে খাতা-কলম চেয়ে পড়ালেখা করাচ্ছেন। লিপি বলেন, যেভাবে সব কিছুর দাম বেড়েছে, গরিবদের সন্তানদের আর লেখাপড়া হবে না।
বাগেরহাটের বিভিন্ন স্টেশনারি দোকান ঘুরে দেখা যায়, সব ধরনের কাগজ, কলম, পেনসিল, রাবার, মার্কার, স্ট্যাপলার, পিন, জ্যামিতি বক্স, কলমের বক্স, স্কেল, কাটার, অফিস ফাইল, ক্যালকুলেটর, ক্লিপবোর্ড, প্রিন্টারের কালিসহ শিক্ষা-সংশ্নিষ্ট কাজে ব্যবহূত প্রায় সব উপকরণের দাম বেড়েছে।
বিক্রেতারা বলছেন, পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে কাগজের দাম। মাস দুয়েক আগে সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বাড়লেও এখন বাড়ছে দিনের ব্যবধানে।
সদর উপজেলার কালাড়াপাড়া এলাকার জেমিস কম্পিউটার অ্যান্ড ফটোস্ট্যাট দোকানের স্বত্বাধিকারী জেমিস মল্লিক এবং শহরের জননী স্টেশনারি পণ্যের পাইকারি বিক্রেতা বিধান চক্রবর্তী জানান, সাদা কাগজের ৮০ পৃষ্ঠার খাতার দাম ছয় মাস আগে ছিল ১৮ টাকা, দুই মাস আগে ২২ টাকা এবং বর্তমান দাম ৩০ টাকা। একইভাবে ১২০ পৃষ্ঠার সাদা খাতার দাম ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪০ ও বর্তমানে ৫০ টাকা। ২০০ পৃষ্ঠার সাদা খাতার দাম ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ ও বর্তমানে ৮০ টাকা হয়েছে। দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এসব খাতা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে এরচেয়ে অন্তত ১০ টাকা বেশিতে।
ভালো মানের প্রতি রিম সাদা কাগজের দাম ছয় মাস আগে ছিল ২৫০ টাকা, দুই মাস আগে ৩০০ ও বর্তমানে ৪৮০ টাকা। মাঝারি মানের কাগজের (৭০ গ্রাম) প্রতি রিম বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ টাকায়, যা দুই মাস আগে ২১০ ও ছয় মাস আগে ছিল ১৮০ টাকা।
ছয় মাস আগে যে নিউজ প্রিন্ট কাগজ ছিল ১৬০ টাকা, দুই মাস আগে তার দাম দাঁড়ায় ১৮০ এবং এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়।
ছয় মাস আগে ৭২ পৃষ্ঠার একটি ব্যবহারিক খাতা বিক্রি হতো ৩৫ টাকায়, দুই মাস আগে এর দাম বেড়ে হয় ৪২ টাকা, এখন আরও বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা। একইভাবে ১২০ পৃষ্ঠার ব্যবহারিক খাতা ৪০ টাকা থেকে বেড়ে দুই মাস আগে ৫০ এবং এখন ৬৫ টাকা হয়েছে।
ভালো মানের জ্যামিতি বক্স ছয় মাস আগে পাওয়া যেত ১০০ টাকায়। দুই মাস আগে এর দাম দাঁড়ায় ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায়। একইভাবে মধ্যম মানের জ্যামিতি বক্স ৭০ টাকা থেকে বেড়ে দুই মাস আগে ৯০ এবং এখন ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪০ টাকার নিম্নমানের জ্যামিতি বক্সের
দাম ৪৫ টাকা হয়ে এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
এক ডজন পেন্সিল ছয় মাস আগে ছিল ৭০ টাকা, দুই মাস আগে ৮০, বর্তমানে ৯৫ টাকা। এক ডজন কলম ৫০ টাকা থেকে বেড়ে দুই মাস আগে হয় ৫৫, এখন ৬৫ টাকা।
সাধারণ মানের প্লাস্টিক ফাইল ৩০ টাকায় পাওয়া যেত, দুই মাস আগে এর দাম হয় ৩৫, এখন সেটাই বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়।
যাত্রাপুর এলাকার দিনমজুর আলামিন শেখ। সন্তানদের পড়ালেখার কথা জানতে চাইলে বলেন, 'দুই বেলা খাবারই জুটছে না, আপনারা দেখতিছেন লেখাপড়া। দুই মেয়েরে ভালোভাবে শিক্ষিত করার ইচ্ছা ছিল; কিন্তু আর পেরে উঠছি না। একটু বড় হলেই বিয়ে দিয়ে দিব।'
বাগেরহাট সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শেখ আবু তালেব। বাড়ি রামপাল উপজেলার চাকশ্রী এলাকায়। সম্প্রতি কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। কারণ জানতে চাইলে আবু তালেব বলেন, দুই মাস আগে কলেজে যেতে ভাড়া লাগত ৬০ টাকা, সেই ভাড়া এখন ৯০ টাকা। যে খাতা কিনতেন ৪৫ টাকায়, দুই সপ্তাহ আগে সেই খাতা কিনেছেন ৭০ টাকা দিয়ে। বাবার স্বল্প আয়ে পরিবারের খরচ মেটাতেই হিমশিম অবস্থা। এখন পড়ালেখার টাকা চাইতেও লজ্জা লাগে তাঁর। তাই চাকরি খুঁজছেন।
আবু তালেব তবু চাকরি খুঁজছেন, পড়াশোনাটাও হয়তো চালিয়ে নেবেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে একই এলাকার আছিয়া খাতুনের। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ২০১৯ সালে মারা যান আছিয়ার বাবা হাকিম খান। চার সদস্যের পরিবারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। দুই মেয়ে আছিয়া ও ছুম্মাকে দাদা-দাদির কাছে রেখে মা আয়েশা বেগম ঢাকায় চলে যান কাজের উদ্দেশ্যে। খেয়ে না খেয়ে পড়ালেখা চালাতে থাকেন আছিয়া। ছোট বোনও স্কুলে যাচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু ২০২১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর অর্থের অভাবে স্নাতকে ভর্তি হতে পারেননি আছিয়া।
সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে সংসারের খরচ। মায়ের পাঠানো টাকায় দুই বোনের যে কোনো একজন পড়াশোনা চলতে পারে। নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ূয়া ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে নিজের পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছেন আছিয়া। ভর্তিসহ পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা নেই তার। নিজে কাঁথা সেলাই করে অল্প কিছু টাকা আয় করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল।
বাগেরহাট শহরের স্টুডেন্ট পেপারস হাউসের মালিক শেখ মোহাম্মদ রুমি। দুই দশক ধরে আছেন এই ব্যবসায়। তিনি বলেন, তাঁর ব্যবসায়ী জীবনে এত খারাপ অবস্থা যায়নি। দিন দিন মালপত্রের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি টাকা দিয়েও কাগজ পাচ্ছেন না। গত বছর ১০০ রিম কাগজ বিক্রি করলেও এবার করেছেন ৬০ রিম। ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে।
জেমিস কম্পিউটার অ্যান্ড ফটোস্ট্যাট দোকানের স্বত্বাধিকারী জেমিস মল্লিক বলেন, আগে ১ পৃষ্ঠা ফটোকপিতে নিতেন ২ টাকা, এখন নিতে হচ্ছে ৩ টাকা। প্রিন্ট দিতে ২০ টাকা নিলেও আগের চেয়ে লাভ কম হচ্ছে।
প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের ওপর মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব জানতে কথা হয় সদর উপজেলার কাড়াপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হোসনেয়ারা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রামে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই নিম্নবিত্ত পরিবারের। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তাঁরা যথাসম্ভব ছাড় দেন শিক্ষার্থীদের। কিন্তু প্রায় সব শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবারগুলো আর পেরে উঠছে না। ফলে প্রভাব পড়ছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে।
বেলায়েত হোসেন ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক মোল্লা মাসুদুল হক বলেন, দফায় দফায় শিক্ষা উপকরণের মূল্য বেড়েছে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অভিভাবকরা সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এতে করে অনেক শিক্ষার্থী পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে কাজে যুক্ত হচ্ছে।
বাগেরহাট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক মন্দার কারণে বাজারে শিক্ষা উপকরণের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় উপকরণ আগেই কিনে রেখেছে। সরকার বছরের শুরুতেই বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বই দেয়। ফলে কিছু উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে।
- বিষয় :
- পড়ালেখা
- পড়ালেখার খরচ
- খাতা
- পেন্সিল