শেরপুরে চড়া সুদে দাদন ব্যবসা

প্রতীকী ছবি
দেবাশীষ ভট্টাচার্য, শেরপুর
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৮:৪৫
শেরপুরে চড়া সুদের চাপে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। সুদ দিতে না পারায় গরু, বসতঘর পর্যন্ত নিয়ে গেছেন সুদের কারবারিরা। তাঁরা মাসিক কিস্তিতে চড়া সুদে ঋণ দেন। মাসে ১০০ টাকায় কেউ নেন ৩ টাকা, কেউ ৫, আবার বিপদে পড়লে সেই সুদ ৬-৭ টাকা হারেও নেওয়া হয়। তাঁদের থেকে টাকা নিয়ে সুদ দিতে না পেরে নিঃস্ব অনেকে এখন এলাকা ছাড়া।
সমবায় সমিতির নিবন্ধন নিয়ে দাদন ব্যবসা করছেন অনেক ব্যবসায়ী। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেরাই সুদের কারবার করছেন কেউ কেউ। এক সময় যাদের নুন আনতে পানতা ফুরাত, তাঁরা দাদন ব্যবসা করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। কেউ কেউ হয়েছেন সমাজসেবক। রাজনৈতিক দলের বড় নেতাও বনে গেছেন অনেকে। জেলায় তাঁদের প্রভাব এতটাই যে, তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস নেই কারও। গ্রাহকদের কাছ থেকে সাদা চেক নেন তাঁরা। পাশাপাশি ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে সই নিয়ে থাকেন। কখনও কখনও স্বর্ণালংকার জমা রাখেন। যদি কখনও গ্রাহকরা টাকা দিতে না পারেন, তখন ইচ্ছেমতো ব্যাংকের চেকে টাকার অঙ্ক বসিয়ে মামলা দেন।
প্রায় ছয় বছর আগে জেলা শহরের নয়আনী বাজারের মহারাজ কমপ্লেক্সের একটি দোকান ভাড়া নেন কাপড় ব্যবসায়ী সত্যসাহা ও তাঁর ছেলে জয়দেব সাহা। তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল নবরূপা বস্ত্রালয়। তিনি চড়া সুদে (মাসিক ৪-৫ টাকা হারে) কয়েকজনের কাছ থেকে কোটি টাকা ঋণ নেন। ওই কমপ্লেক্সের মালিক বাবু চন্দের ভাষ্য, দোকান ভাড়া নেওয়ার পর ব্যবসা বেশ ভালো ছিল। বছর দুয়েক আগে তিনি জানতে পারেন, চড়া সুদে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে সত্যসাহা ও তাঁর ছেলে জয়দেব ঋণ নিয়েছেন। করোনা মহামারি শুরু হলে ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। তখন চাপে পড়ে সুদের প্রায় ৭০-৮০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হন সত্যসাহা। কিন্তু এরপরও আসল টাকার জন্য চাপ দেওয়া শুরু হলে পালিয়ে যান তিনি। ওই কমপ্লেক্সের মালিক আরও বলেন, 'সত্যসাহা পালিয়ে যাওয়ার পরে আমার দোকানে তালা লাগিয়ে দেয় সুদখোরের দল। পরে ৫ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে রেহাই পাই।'
একইভাবে শহরের হাসিনা মার্কেটের কম্পিউটার ব্যবসায়ী রাজিব বণিক কোটি টাকা ঋণ শোধ করর পরও দাদন ব্যবাসায়ীদের চাপে পড়ে দেশান্তরী হয়েছেন বলে জানান স্থানীয়রা। এ ছাড়া নয়আনী বাজারের কারুয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী মদন সাহা চড়া সুদে ঋণ নিয়ে লোকসানে পড়ে পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন।
নয়আনী বাজারের হক মার্কেটের বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল উত্তম সাহার কাপড়ের দোকান। চড়া সুদ দিতে গিয়ে এখন নিঃস্ব তিনি। তাঁর আশঙ্কা, সব তথ্য দিলে বিপদে পড়তে পারেন তাঁরা। তিনি বলেন, '১০ লাখ টাকা নিয়ে গত কয়েক বছরে প্রায় ১৫ লাখ টাকা সুদ দিয়েছি। তারপরও সুদের টাকা শেষ হচ্ছে না। আমি এখন নিঃস্ব।'
ঢাকায় রিকশা চালাতেন ঝিনাইগাতী উপজেলার সাদেকুল ইসলাম। বছর দেড়েক আগে পারিবারিক প্রয়োজনে গৌরীপুর গ্রামের সুদ কারবারি মালেক মিয়ার কাছ থেকে সুদে ১৮ হাজার টাকা ঋণ নেন। পরে রিকশা চালিয়ে ২৩ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। এরপরও ৪০ হাজার টাকার দাবিনামা মেটাতে না পারায় সাদেকুলের বাবা ও ভাইয়ের তিনটি গরু জোর করে নিয়ে যান মালেক মিয়া। এর কিছু দিন পর সাদেকুলের বসতঘর ভেঙে টিন, খুঁটি ও আসবাবপত্র নিয়ে যান মালেক। পরে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার হন মালেক মিয়া।
কেবল সাদেকুল ও মনোয়ারা দম্পতিই নন, মালেকের মতো সুদখোর মহাজনদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার।
শেরপুরে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধিত সমিতির সংখ্যা ১ হাজার ১০৫টি। ব্যক্তিগত সুদের ব্যবসার বাইরেও সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধনের নামে অনেকেই জেলাজুড়ে সুদের কারবারে জড়িত। ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে টাকা ধার পাওয়া যতটা কষ্টের, ঠিক ততটাই সহজ এসব সমিতি বা ব্যক্তিদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া।
সদর উপজেলার চরশেরপুর তালুকপাড়া গ্রামের বাবুল মিয়া বলেন, দাদন ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে সোয়া ১ লাখ টাকা নিয়েছিলেন তিনি। পরে তিন কিস্তিতে ৬৫ হাজার টাকা সুদ দিয়েছেন। তবে আসল ছাড়াই আরও ১ লাখ টাকা লাভ দাবি করছেন রফিকুল। এ জন্য কিছুদিন ধরে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শেরপুর শহরে ভাড়া থাকছেন তিনি।
শহরের আখেরমামুদ বাজারের ব্যবসায়ী মিসকিন মিয়া জানান, এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুদে ৩ লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি। এরপর প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো পরিশোধ করা হয়। এরপরও সুদ দাবি করলে স্থানীয় মুরব্বিদের মধ্যস্থতায় আসল ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে তাঁকে।
সমবায় সমিতির নিবন্ধন নিয়ে চড়া সুদে দাদন ব্যবসার বিষয়ে কথা হয় জেলা সমবায় কর্মকর্তা আবুল কাশেমের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, সমবায়ের নিবন্ধন নিয়ে ব্যাংকের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করা বা সদস্যদের বাইরে ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। এ রকম অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকার করা হয়।
পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বিপিএম বলেন, 'আমাদের কাছে কোনো ভুক্তভোগী অভিযোগ দিলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেই। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।