বালুখেকোদের হাতে ফসলি জমি, রাস্তার সর্বনাশ

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গড়ফতুর জয়গঞ্জ ঘাট এলাকায় ফসলি জমি ধ্বংস করে চলছে বালু উত্তোলন ও পরিবহন - সমকাল
বিপুল সরকার সানি, দিনাজপুর
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৪:২৪
আত্রাই নদীর জয়গঞ্জ খেয়াঘাট উত্তরাঞ্চলের তিন জেলার মানুষের কান্নার কারণ। সেতু না থাকায় সারাবছর দুর্ভোগ পোহাতে হয় আশপাশের কয়েকটি উপজেলার লাখ লাখ মানুষকে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে নদীর দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জের শতগ্রাম ইউনিয়নের ঝাড়বাড়ির গড়ফতু গ্রাম ও কাশিমনগর অংশে বালুমহাল ইজারা। এখানে মেশিন দিয়ে নদীর গভীর থেকে বালু তোলায় এবং ইজারাবহির্ভূত জায়গায় খনন করায় পরিবর্তন হয়েছে প্রবাহপথ। ধসে পড়ছে আশপাশের ফসলি জমি। ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে শতাধিক একর মাটি। উত্তোলিত বালু পরিবহনে বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে ডাম্প ট্রাকগুলো।
এতে গ্রামের মানুষের অতি যত্নের সড়কও নষ্ট হয়েছে, হয়ে পড়েছে চলাচলের অনুপযোগী। ঝুঁকিপূর্ণ এই সড়কে শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু এবং বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার পরও টনক নড়েনি কারও। বালুখেকোদের প্রভাবের কাছে প্রশাসনও দর্শকের ভূমিকায় আছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
স্থানীয়রা বলেন, নদীর দু'ধার বর্ষায় পানিতে পূর্ণ থাকলেও শুস্ক মৌসুমে ভরে উঠত সবুজে। পানির ধারে বোরো ধান ছাড়াও চর ও আশপাশের জমিতে চাষ হতো মিষ্টি কুমড়া, তরমুজ, ভুট্টা, পাট, গম, সরিষাসহ নানা ফসল। বিকেলে সমাগম ঘটত বহু প্রকৃতিপ্রেমীর। কিন্তু এখন শুধু ভটভট শব্দ, ধোঁয়া আর তেল পোড়ার গন্ধ পাওয়া যায়। এখানে নজর পড়েছে শকুনের। বালুমহালের নামে গিলছে ফসলি জমি। জায়গাটি পরিণত হয়েছে আতঙ্কের ঘাঁটিতে। বালুখেকো ইজারাদারদের খোঁড়া গর্তে পড়ে ঘটছে হতাহতের ঘটনা। ডাম্প ট্রাকে পিষ্ট হচ্ছে স্কুলগামী শিশুরা। বারবার অভিযোগ দেওয়ার পরও মিলছে না কোনো প্রতিকার। এখন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
ঘাট এলাকায় ঝাড়বাড়ির লালমিয়ার ২০ বিঘা জমি ছিল। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু তোলায় তাঁর আট বিঘা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাতে ভুট্টা আবাদ করেছি। কিন্তু শুস্ক মৌসুমেও প্রতিনিয়ত যেভাবে ভাঙছে, আর কিছু থাকবে না মনে হয়। তাই কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। অন্য জমিগুলোও ধসে গেলে আমাকে পথে বসতে হবে।
পার্শ্ববর্তী কাশিমনগরের জামাল উদ্দিনের স্ত্রী রওশন আরা বলেন, 'হামার অল্প এগনা বর্গা জমিন, এগিনা আবাদ করিয়াই হামাক চলিবার নাগে। মেশিন দিয়া বালু কাটায় জমিনগুলা ভাঙ্গি যাছে। একন ক্যাংকরি আবাদ করিমো? চাষবাস না করিলে খামো কী? ছোয়াগুলাকই-বা কেংকো মানুষ করিমো?'
রওশন আরার ছেলে মো. বিপ্লব তাদের ভুট্টা খেতে দাঁড়িয়ে বলেন, বর্গায় নেওয়া জমি চাষ করেই আমাদের পরিবার চলে। সবুজ গাছগুলো দেখে খুব মায়া হচ্ছে আর কান্না আসছে- কখন জানি নদীতে বিলীন হয়ে যায় এই ভেবে। এই জমি আমাদের সারাবছরের খাবার দেয়। এক বিঘার মতো ধসে গেছে। শঙ্কায় আছি, বাকি জমি ভেঙে গেলে কী করে খাব?
এ রকম ঝাড়বাড়ি, কাশিমনগর, গড়ফতু, বলদিয়াপাড়া, ধুলাউড়ী, প্রসাদপাড়াসহ আশপাশের শতাধিক কৃষক নদীভাঙনের শিকার। তাঁদের মধ্যে কৃষক আরশেদ আলীর ২০ বিঘা, রহিমা খাতুনের ১৫ শতক, লালচানের ১ একর ৭৫ শতক জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বলে তাঁরা জানান। এ ছাড়া জমি হারিয়েছেন লাইলী বেগম, রফিকুল ইসলামসহ শতাধিক কৃষক। তাঁদের প্রশ্ন- সরকারের কাছে কি ফসলি জমির চেয়ে ইজারার রাজস্ব বেশি গুরুত্বপূর্ণ? ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বলেন, অবিলম্বে এখান থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। ইজারা বাতিল করতে হবে। নদী বাঁচাতে হবে। চাষি বাঁচাতে হবে। চাষ না হলে মানুষ খাবে কী? যে জীবনগুলো গেছে, সেগুলো কেউ কি ফিরিয়ে দিতে পারবে?
ফসলি জমি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জামতলী জনকল্যাণ সমিতি। সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ইউসুফ আলী বলেন, এখানকার ৯৯ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। নদীতীর ও দুই পাড়ে বহু জমি আছে, যেগুলো হাজার হাজার মানুষের অন্ন জোগায়। কিন্তু বালুমহাল ইজারা দেওয়ায় সংশ্নিষ্ট কৃষকরা আজ পথে বসতে চলেছেন। ফসলি জমির পাশাপাশি বিলীন হচ্ছে গাছপালাও। এর বাইরে বালু পরিবহনের গাড়িগুলোও চলাচল করে বেপরোয়া গতিতে। গ্রাম্য রাস্তায়ও তারা কাউকে পরোয়া করে না। এতে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। ড্রেজারের গর্তে পড়েই দু'জন মারা গেছে। নদীতে আসছে না অতিথি পাখিও। পরিবহনের বালু উড়ে বায়ুদূষণে মানুষের ফুসফুসজনিত রোগ বাড়ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন স্থানীয় আবু বকর সিদ্দিক। তিনি বলেন, বালুমহাল ইজারার মাধ্যমে কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ীকে 'রামরাজ্য' দেওয়া হয়েছে। তবে প্রান্তিক কৃষক ও সোনা ফলানোর জমির দিকে খেয়াল রাখা হয়নি। ইতোমধ্যে ১০০ একর জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। আরও প্রায় ৫০০ একর জমি ভাঙনের মুখে। এ বিষয়ে ইউএনওকে অভিযোগও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কৃষকরা তো গরিব-অসহায়, তাঁদের কথা কে শোনে? এ প্রেক্ষাপটে বালুখেকোদের হাত থেকে বাঁচাতে গত রোববার মহালের কাছে মানববন্ধন করেছেন এলাকাবাসী।
বালুমহাল ইজারাদারদের মধ্যে আছেন মেসার্স উম্মে আরা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী নূর আলম। তিনি দাবি করেন, ইজারার নির্দিষ্ট জায়গা থেকেই বালু তোলা হচ্ছে। এতে ফসলের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। ইজারার শর্ত মেনেই কার্যক্রম চলছে। আমাদের কারণে কারও কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
ইউএনও জিনাত রেহেনা বলেন, কৃষকরা অভিযোগ দিয়েছেন। তদন্তের জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হবে। ওই বালুমহাল ইজারা না দিলে বালুখেকোদের নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হবে। এ জন্য তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকী বলেন, ফসলি জমি নষ্ট করে রাজস্ব চাই না। প্রধানমন্ত্রীরও এমন নির্দেশনা আছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- বিষয় :
- আত্রাই নদী
- বালুখেকো
- বীরগঞ্জ
- ফসলি জমি