ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

চট্টগ্রামে ১৫০ কোটি টাকার ময়লা বাণিজ্যের ফাঁদ

চট্টগ্রামে ১৫০ কোটি টাকার ময়লা বাণিজ্যের ফাঁদ

ফাইল ছবি

আব্দুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৩:৫৮

বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করতে নগরবাসীর কাছ থেকে গত অর্থবছরে ৭৫ কোটি টাকা পরিচ্ছন্নতা কর আদায় করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এই বিভাগে লোকবলও রয়েছে সাড়ে ছয় হাজার। এর মধ্যে ঘরে ঘরে গিয়ে (ডোর-টু-ডোর) সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহের নামে একসঙ্গে লোক নিয়োগ দেওয়া হয় দুই হাজার। এখন সেই বর্জ্য সংগ্রহের কাজ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিচ্ছে সিটি করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জ্য সংগ্রহের নামে লোকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি টাকা। এভাবে সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডে নিজেদের কাজ মধ্যস্বত্বভোগীর হাতে তুলে দিলে প্রতি বছর অন্তত ১৫০ কোটি টাকার ময়লা বাণিজ্য হবে। সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন, লাভজনক এই ব্যবসা হাতিয়ে নিতে তৈরি হবে নৈরাজ্য, হানাহানি ও দুর্বৃত্তায়ন। এ আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ তুলে দেওয়া হলে পরিচ্ছন্নতা কর আদায় না করার দাবি জানিয়েছেন বাড়ির মালিকরা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে সিটি করপোরেশনের তিন কার্যাবলি উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- নগর এলাকার রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট, ফুটপাত নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ; বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণ এবং সড়ক বাতি স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ। এর মধ্যে ৪ থেকে ৭ শতাংশ রয়েছে পরিচ্ছন্নতা কর।

বাসাবাড়ি, দোকান, রেস্তোরাঁ, কমিউনিটি সেন্টার ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে বছরে ১০ লাখ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে সিটি করপোরেশন। বর্জ্য সংগ্রহ ও নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার কাজে নিয়োজিত ৬ হাজার ৬৫৫ পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও চালক। ২০১৬ সালে বাসায় বাসায় গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করতে ২ হাজার ৬৫ জন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের বেতন-ভাতা খাতে সিটি করপোরেশনের বছরে ব্যয় হয় ৫০ কোটি টাকার বেশি।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, বর্জ্য অপসারণ মূল কাজ হলেও সেটি এখন বেসরকারি খাতে তুলে দিচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ইতোমধ্যে ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড ও ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহ করছে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট সার্ভিস এবং ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে মেসার্স পাওয়ার সোর্স। ২ নম্বর জালালাবাদ, ৪ নম্বর চান্দগাঁও ও ৬ নম্বর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।
দুই ওয়ার্ডে নিয়োজিত দুই প্রতিষ্ঠান প্রতি বাসা থেকে ময়লা সংগ্রহের জন্য আদায় করছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা, দোকান থেকে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা, হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে দেড় হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এ ছাড়া শিল্পকারখানা থেকে তিন থেকে ১০ হাজার টাকা, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতি ১০০ জনের সৃষ্ট বর্জ্যে ২০০ টাকা, শপিংমল ও মার্কেট থেকে দুই হাজার থেকে ১০ হাজার এবং ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে ২০ থেকে ৫০ টাকা আদায় করা হচ্ছে।

বাদুরতলা আরকান সোসাইটির বাসিন্দা গৃহিণী হেলেন আক্তার বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে ৭ শতাংশ পরিচ্ছন্নতা কর নেওয়া হয়। বিপরীতে বাসা থেকে গৃহস্থালি বর্জ্য নিয়ে যাওয়ার কথা। সেটা না করায় আমাদেরকেই পরিবারপ্রতি বাড়তি ১০০ টাকা করে দিয়ে ময়লা ফেলতে হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যদি টাকা দিয়ে বর্জ্য ফেলতে হয়, তাহলে পরিচ্ছন্নতা কর কেন নেবে সিটি করপোরেশন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাবে নগরে হোল্ডিং রয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ১৪০টি। অধিকাংশ হোল্ডিংয়ে ছয় থেকে ১২টি করে ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। একটি হোল্ডিংয়ে গড়ে ছয়টি ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে গড়ে ১০০ টাকা করে আদায় করা হয়। এই হিসাবে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে প্রায় ১২ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে। বছরে যা প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ ও কমিউনিটি সেন্টার থেকেও হাজার টাকার বেশি আদায় করা হবে।
সিটি করপোরেশনের একাধিক কাউন্সিলর বলেন, ঢাকায় ময়লা বাণিজ্য নিয়ে কী হয়, এটা সবাই জানে। এখানে যে হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। লোকজন যখন দেখবে এটি লাভজনক ব্যবসা, স্বাভাবিকভাবে অনেকে এখানে যুক্ত হতে চাইবে। অনেকে নিজেদের লোক নিয়োগ দেবে। ক্ষমতার পালাবদল হলে আরেক দল কাজ বাগিয়ে নিতে চাইবে। স্বাভাবিকভাবে হানাহানি ও নৈরাজ্য হওয়ার আশঙ্কা তো থাকেই। মেয়র ও কয়েকজন কাউন্সিলরের আগ্রহে এটি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী সমকালকে বলেন, সিটি করপোরেশনের কর্মী দিয়ে বর্জ্য সংগ্রহে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছি। এটা যদি জনগণ গ্রহণ করে তাহলে তাদের ওপর যাতে চাপ না হয়, সেভাবে চিন্তা করা হচ্ছে। জনগণ যদি গ্রহণ না করে তাহলে আগে যেভাবে পরিস্কার করেছি সেভাবে করব।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোবারক আলী বলেন, যে দুটি ওয়ার্ডে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, সেখানে বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই খাল-নালায় বর্জ্য কম যাচ্ছে। পরিচ্ছন্নতা বিভাগে প্রতি মাসে লোকবল কমছে। নতুন করে লোক নিয়োগ দেওয়ার অনুমতিও মিলছে না। তাই ক্রমান্বয়ে সব ওয়ার্ডে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করতে হয়, তাহলে সিটি করপোরেশনের কাজ কী? তারা কেন কর্তৃপক্ষ হয়ে থাকবে? মানুষ যদি সোসাইটিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বর্জ্য সংগ্রহ করে ডাস্টবিনে রাখে, তাহলে ভবন মালিকদের কর দিতে হবে কেন? এভাবে চললে সিটি করপোরেশনের উচিত পরিচ্ছন্নতা কর না নেওয়া।


whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×