মামলা গায়েবি, সেখানেও নাম নেই আজমের
সমকাল প্রতিবেদক, ঢাকা ও কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৩:৫৭
কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজমকে যে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়, সেই ঘটনার সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। স্থানীয়রা একে গায়েবি মামলা বলে দাবি করেছেন। বিস্ম্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলাটির বাদী হিসেবে কালিয়াকৈর পৌর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের অফিস সহকারী আব্দুল মান্নান শেখের কথা বলা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। মামলার ভাষ্য, ২৮ নভেম্বর রাতে চন্দ্রায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ম্ফোরিত হয়। তবে বাদী প্রথমে দাবি করেন, ঘটনার সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। অবশ্য পরদিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তিনি এর উল্টো বক্তব্য দেন। তখনও তিনি বলেন, সব দেখলেও কাউকে চিনতে পারেননি। সে ক্ষেত্রে মামলায় বিএনপির ১১ নেতাকর্মীকে কেন আসামি করা হলো- এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।
মায়ের মৃত্যুতে মঙ্গলবার প্যারোলে মুক্ত হয়ে জানাজায় অংশ নেওয়ার সময় আলী আজমের হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খুলে না দেওয়ার ঘটনায় স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিভিন্ন মহলে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। আইনজীবীরা মনে করেন, এটি অমানবিক এবং আইনের পরিপন্থি। এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এমন পরিস্থিতিতে সমকালের পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় 'গায়েবি' মামলায়। এমনকি এজাহারেও আসামি হিসেবে তাঁর নাম ছিল না। পুলিশের দাবি, তদন্তে সংশ্নিষ্টতা পাওয়ায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গতকাল বুধবার বলেন, 'আমি মনে করি, জানাজার সময় তাঁর হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খুলে দিলে ভালো হতো।' তবে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও জেলা কারাগারের জেল সুপার দাবি করেছেন, হাতকড়া আর ডান্ডাবেড়ি নিয়ে মায়ের জানাজা পড়ানো কারাবিধি মোতাবেক হয়েছে। এতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেনি।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে সামনে রেখে ককটেল বিস্ম্ফোরণের অভিযোগে ২৯ নভেম্বর কালিয়াকৈর থানায় মামলা হয়। এতে উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১১ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫০ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় ১ ডিসেম্বর রাতে আলী আজমকে কালিয়াকৈরের পাবরিয়াচালা গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলার বাদী আব্দুল মান্নান শেখ ৩০ নভেম্বর সাংবাদিকদের বলেন, 'ঘটনার সময় আমি এক আত্মীয়ের বাড়িতে বিয়ের দাওয়াতে ছিলাম। ককটেল বিস্ম্ফোরণের ঘটনা জানি না।' তবে কালিয়াকৈর থানা পুলিশ তাঁকে ডেকে নিয়ে একটি কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। ১ ডিসেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুরাদ কবীর তাঁর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে আব্দুল মান্নান শেখ দাবি করেন, ঘটনার দিন তিনি সব দেখেছেন। তবে কাউকে চিনতে পারেননি। আগের দিন অন্যরকম বক্তব্য দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানান, তিন-চারজন যুবক ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁকে ওই কথা (কিছু জানেন না) বলতে বাধ্য করে।
আর আব্দুল মান্নান গতকাল বলেন, মামলার বিষয়ে কালিয়াকৈর থানা পুলিশ যা করার করবে। আমি এ বিষয়ে আর কিছু বলতে পারব না। এদিকে মামলায় বর্ণিত ঘটনাস্থলের আশপাশের কয়েকজন দোকানি জানান, সেদিন রাত ১১টা পর্যন্ত তাঁদের দোকান খোলা ছিল। এর মধ্যে কোনো মিছিল বা ককটেল বিস্ম্ফোরণ এবং আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেনি।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, আলী আজম ছাড়াও পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল কুদ্দুস, আট নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সারোয়ার হোসেন আকুলসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
এর মধ্যে ১৮ ডিসেম্বর আলী আজমের মা সাহেরা বেগম (৬৭) মারা যান। পরদিন মায়ের জানাজায় অংশ নেওয়ার জন্য তাঁর পক্ষে আইনজীবীর মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করা হয়। অনুমতি মিললে মঙ্গলবার সকালে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আলী আজমকে তাঁর বাড়ি পাবরিয়াচালা গ্রামে নিয়ে যান কারারক্ষীরা। সেখানে মায়ের জানাজা নিজে পড়ানোর কথা বললে হাতকড়ার একটি পাশ খুলে দেওয়া হয়। তখন এলাকাবাসী ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়ার অনুরোধ করলে কারারক্ষীরা জানান, তাঁদের কাছে চাবি নেই। এক হাতে অজু করে মায়ের জানাজা শেষে কবরে একমুঠো মাটি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারারক্ষীরা তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ফিরে যান।
কালিয়াকৈর থানার ওসি আকবর আলী খান বলেন, তাঁদের দায়িত্ব ছিল নিরাপত্তা দেওয়া। ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়া-না দেওয়ার বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষের। আর তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আলী আজমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, 'প্যারোল প্রদানের কর্তৃপক্ষ হলো জেলা প্রশাসক। আমার কাছে আবেদন করেছে, আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তার নির্দেশনা সংবলিত প্যারোলে মুক্তির আদেশ দিয়েছি।' তিনি বলেন, জেলকোড বা অন্যান্য বিষয়ে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবে। তিনি এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ঢাকার আদালত চত্বর থেকে জঙ্গির পলায়নের বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেন।
গাজীপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার বজলুর রশিদ আখন্দ বলেন, 'আসামি জেলের বাইরে গেছে, তাই নিরাপত্তার জন্য ডান্ডাবেড়ি দিয়েছি। ওয়ারেন্টে দাগি-নিদাগি কোনো কিছু বলা থাকে না। আমি শুধু মামলার সেকশনগুলো (ধারা) দেখি। সেকশনে আছে, বিস্টেম্ফারক দ্রব্য আইনে ৩, ৪, ৫ ধারা; বিস্টেম্ফারক আইনের মামলা আমি কি ছোট করে দেখব? ৩৮০ ধারার মামলা, গরুর চুরি মামলা, সেটাও আমি ছোট করে দেখতে পারি না।'
স্বজন ও প্রতিবেশীদের ক্ষোভ :গতকাল সকালে বিএনপি নেতা আলী আজমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কারা কর্তৃপক্ষের 'অমানবিক আচরণে' স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাঁরা জানান, সাহেরা বেগম মৃত্যুর আগে বলে যান, তাঁর তৃতীয় সন্তান আলী আজম যেন জানাজা পড়ায়। মায়ের কথা রাখতেই তাঁকে জানাজা পড়াতে হয়।
কারাবন্দি বিএনপি নেতার মেয়ে রুমাইয়া আফরিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, দাদুর জানাজায় পুলিশ বাবাকে নিয়ে এলেও কথা বলতে বাধা দিয়েছে, কাছেও যেতে দেয়নি। 'মিথ্যা মামলা' প্রত্যাহার করে বাবার নিঃশর্ত মুক্তি চান তিনি।
ছোট ভাই আতাউর রহমান জানান, এলাকার বান্দর মার্কেট বাজারে পোলট্রি ফিডের ব্যবসা করেন আলী আজম। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় তাঁকে কারাগারে রাখা হয়েছে।
আলী আজমের স্ত্রী মাহবুবা আক্তার লিপি জানান, ১ ডিসেম্বর রাত ১১টার দিকে তাঁর স্বামীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে নিয়ে যায় কালিয়াকৈর থানা পুলিশ। পুলিশ জানায়, নাশকতার একটি মামলা হয়েছে তাঁর নামে। পরে জানতে পারেন, তাঁর নামে কোনো মামলা নেই।
হাতকড়া খুলে দিলে ভালো হতো- তথ্যমন্ত্রী :তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি বিষয়টি চেক করেছি, গাজীপুরের পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। ডান্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরানো কারা প্রশাসনের কাজ। সেটি পুলিশের অধীনে নয়, আইজি প্রিজনের অধীনে। যেহেতু কয়েক দিন আগে কয়েকজন জঙ্গি পালিয়ে গেছে, এ জন্য তারা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি জানতেন না। যাঁরা ওই বিএনপি নেতাকে বহন করে এনেছিলেন, শুধু তাঁরাই জানতেন। তবে আমি মনে করি, জানাজার সময় তাঁর ডান্ডাবেড়ি ও হাতকড়া খুলে দিলে ভালো হতো।
আসকের নিন্দা :আসক এক বিবৃতিতে বলেছে, সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচার বা দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। সংবিধানে এমন বিস্তৃত অধিকার থাকা সত্ত্বেও একজন নাগরিককে মায়ের জানাজায় ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে নিয়ে যাওয়া শুধু অমানবিকই নয় বরং মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থি। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডান্ডাবেড়ি পরানোবিষয়ক উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও অনুসরণ করা হয়নি। তা ছাড়া তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট মামলার আসামি নন। আসক এ ধরনের নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অসংবেদনশীল আচরণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।
- বিষয় :
- মামলা গায়েবি