সারাদিন গাড়ি চালিয়েও সংসার চালাতে পারি না
ফাইল ছবি
হাসান হিমালয়, খুলনা
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৩:৩৫
'সকাল ৭টার মধ্যে গাড়ি লইয়া বাইর হই, দুপুর পর্যন্ত চালাই। আবার বিকাল ৩-৪টার দিকে বাইর হই, রাইত ৯-১০টায় বাড়িতে ফিরি। সারাদিন গাড়ি চালাইয়া যে টাকা পাই, তাতে সংসার চলে না।'
এই আক্ষেপ ইজিবাইক চালক মারুফের। শুক্রবার ভোরে খুলনার শিববাড়ী মোড়ে তাঁরই ইজিবাইকে বসে কথা হচ্ছিল মারুফের সঙ্গে। যাত্রী হিসেবেই তাঁর কাছে জানতে চাওয়া- দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ছুটির দিনে শীতের ভোরে সড়কে মানুষ ছিল কম। যাত্রীর জন্য অপেক্ষায় থাকায় মারুফ যেন কষ্ট আর সংকটের কথা বলতে পেরে হালকা হলেন।
বলা শুরু করলেন, দিন-রাতে ১০ ঘণ্টা ইজিবাইক চালালে ৭০০-৮০০ টাকা পাওয়া যায়। এর মধ্যে মালিককে দিতে হয় ৫৫০ টাকা। বাড়ি ভাড়ার জন্য টাকা জমা রাখতে হয়। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, সমিতির কিস্তির জন্য টাকা আলাদা রাখতে হয়। বাকি যে টাকা থাকে, তাতে চাল কিনলে, তেল কেনা যায় না। ডাল কিনলে, আলু কেনা যায় না। একদিন ১০ ঘণ্টা চালালে পিঠ-কোমর ব্যথা হয়ে যায়। কিন্তু কী করব, সেই অবস্থায়ই গাড়ি চালাতে হয়।
ক্ষোভ নিয়েই যোগ করেন, গত ১০ বছরে খুলনায় ইজিবাইকের যাত্রীদের ভাড়া বেড়েছে ৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা। অথচ ৮০ টাকার সয়াবিন তেল ২০০ টাকা হয়েছে। ৪০ টাকার চাল ৬০ টাকা। ভালোমন্দ খেতে পারি না অনেক দিন। শেষ কবে গরুর মাংস খেয়েছি, মনে নেই।
মারুফের ইজিবাইকে গল্লামারী মোড় নেমে যাত্রী হলাম সিরাজুল ইসলামের ইজিবাইকে। তখনও রাস্তা ফাঁকা। একই প্রশ্নের উত্তরে তিনিও বলতে লাগলেন অনর্গল। বললেন, করোনার সময়ও খুব কষ্টে গেছে। তখন আয়-রোজগার ছিল না। বড়লোকেরা ও সরকার সাহায্য করেছে। কিন্তু এখন আয় আছে- কিন্তু সংসার চালানোর কষ্ট বেড়েছে।
বাড়তি খরচ কীভাবে মেটান- জানতে চাইলে বললেন, উপায় নেই, তাই খরচ কমাচ্ছি। আগে বাজারে গেলে লিটার হিসাবে তেল কিনতাম, এখন মোড়ের দোকান থেকে ১০০-২০০ গ্রাম করে খোলা তেল কিনি। ভালো মাছ-মাংস খাওয়া বাদ দিয়েছি। ডিমও কিনতে পারি না। ওএমএসের লাইনে দাঁড়িয়ে চাল কেনায় ভাতটা ঠিকমতো খেতে পারছি।
শুধু মারুফ বা সিরাজুল ইসলামই নন; একই রকম কষ্টে আছেন খুলনা নগরীর প্রায় ১৫ হাজার ইজিবাইক চালক। গত এক সপ্তাহে প্রায় ২৫ জন ইজিবাইক চালকের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রতিবেদকের। আয় ও খরচের ভিন্নতা থাকলেও, সবার কষ্ট অভিন্ন। উচ্চ মূল্যের বাজারে জীবিকার যুদ্ধে সবাই কমবেশি বিধ্বস্ত।
খুলনা মহানগরীতে গণপরিবহন চলাচল করে না। এই শূন্যতা পূরণ করেছে ইজিবাইক। নগরীর ভেতরে-বাইরে, দূরে বা কাছে- সব সড়কেই যাতায়াতের সহজ মাধ্যম এই যান। স্বল্প খরচের হওয়ায় নগরবাসীর মাঝে এটি জনপ্রিয়।
আবার বিপরীত প্রতিক্রিয়াও আছে। নগরীতে যানজট এবং সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণও এই ইজিবাইক। সাধারণত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিক-কর্মচারী, চাকরিজীবী, পান ও মুদি দোকানি থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষ কর্মক্ষেত্রে যখন ব্যর্থ হন, তখন ইজিবাইক চালান। এ জন্য নগরে নতুন প্রবাদ তৈরি হয়েছে, 'যে কিছু করে না, সে ইজিবাইক চালায়।'
দেখা যায়, সড়কে যান চালানোর নূ্যনতম জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকায় যানজট তৈরি করেন এসব চালক। গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের মাঝখানে যাত্রী ওঠানামা, যত্রতত্র পার্কিংসহ নানা কারণে যানজট লেগেই থাকে। এসব কারণে ইজিবাইক চালকদের প্রতি ক্ষুব্ধ পুলিশ, কেসিসিসহ সাধারণ মানুষ। যার কারণে ভাড়া বৃদ্ধিসহ তাঁদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় না কাউকেই।
খুলনা নগরীতে ঠিক কত ইজিবাইক চলে, সেই পরিসংখ্যান নেই পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বা কেসিসির কাছে। নগরীতে কেসিসির নিবন্ধিত ইজিবাইক রয়েছে ৭ হাজার ৮৯৭টি। এ ছাড়া পণ্যবাহী ২ হাজার ৮১টি ইজিবাইককে গত বছর থেকে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসব মিলিয়ে নগরীতে প্রায় ১৫ হাজার ইজিবাইক চলাচল করে বলে সবার ধারণা।
ইজিবাইক চালকদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, ভাড়ায় চালক ও মালিকদের সমস্যা দুই রকম। যারা ভাড়ায় ইজিবাইক চালান, দৈনিক ৫৫০ টাকা ভাড়া ছাড়া তাঁদের অন্য খরচ নেই। ভাড়ার টাকা দেওয়ার পর যাতে কিছু টাকা থাকে, সে জন্য তাঁদের বেশি সময় ইজিবাইক চালাতে হয়, তাই তাঁদের কষ্ট বেশি।
আবার যার নিজের ইজিবাইক রয়েছে, বিদ্যুৎ বিল ও গ্যারেজ ভাড়া নিয়ে তাঁর দৈনিক খরচ ১৮০ টাকা। অবশ্য প্রতিবছরই ব্যাটারি ও চাকা পরিবর্তনের পেছনে তাঁর ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ হয়। এই টাকা তাঁদের দৈনিক আয় থেকে জমা রাখতে হয়। ভাড়ার চালকদের চেয়ে মালিকরা কম সময় ইজিবাইক চালান। তবে ভাড়া কম নিয়ে আক্ষেপ সবারই।
নগরীর ২নং কাস্টমঘাট এলাকার বাসিন্দা অলিয়ার রহমান ২০০৮ সাল থেকে ইজিবাইক চালান। সমকালকে তিনি বলেন, ওই সময় সোনাডাঙ্গা থেকে রূপসার ভাড়া ছিল ১০ টাকা। ১৪ বছর পর ভাড়া বেড়ে এখন ১৫ টাকা হয়েছে। ওই সময় বিদ্যুৎ বিল ছিল ৬০ টাকা, এখন সেটা ১৬০ টাকা হয়েছে। ব্যাটারির দাম ছিল ৩৫ হাজার টাকা। এখন ব্যাটারি ৭০-৮০ হাজার টাকা। গ্যারেজ, নাট-বল্টুসহ সব খরচ বেড়েছে। অথচ ভাড়া বাড়াতে গেলে সবাই প্রতিবাদ করে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নগরীর ময়লাপোতা থেকে গল্লামারী, সোনাডাঙ্গা থেকে রূপসা, ময়লাপোতা থেকে বয়রা বাজার পর্যন্ত এই তিনটি রুটের ভাড়া ৫ টাকা করে বেড়েছে। এর বাইরে প্রায়ই চালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে জোর করে বেশি ভাড়া রাখেন- এই নিয়ে প্রায় সড়কে যাত্রী ও চালকদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করতে দেখা যায়।
এর আগে ভাড়া বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হলে, কেসিসির পক্ষ থেকে লাইসেন্স বাতিলের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল।
খুলনা সিটি করপোরেশনের সিনিয়র লাইসেন্স অফিসার নুরুজ্জামান তালুকদার সমকালকে বলেন, ওই সময় চালকরা সিটি করপোরেশন ভাড়া বাড়িয়েছে বলে প্রচার করেছিল। ভাড়া বৃদ্ধি বা কমানো কেসিসির কাজ নয়। এ জন্য ওই সময় নিষেধ করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, চালকরা কষ্টে আছেন, যাত্রীরাও তো ভালো নেই। সাধারণত স্বল্প আয়ের লোকেরা ইজিবাইকে চড়েন। একটি রুটে চালকদের ৫ টাকা ভাড়া বাড়লে, আসা-যাওয়া নিয়ে একজন যাত্রীর খরচ বাড়ে আরও বেশি। এই বাজারে বাড়তি টাকা তাঁরা কোথায় পাবেন?
তিনি বলেন, এটি কেসিসির বিষয় নয়। এ নিয়ে কেসিসির কোনো বক্তব্য নেই।