বিল ইজারা নিয়ে নদী দখল
মুরাদ মৃধা, নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ০০:৪০
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার বিল আটউড়ি জলমহালের ৫৩৬ একর জলাশয় স্থানীয় একটি মৎস্যজীবী সমিতির কাছে ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। তবে বিল ইজারার নামে নদী দখল ও চুক্তি ভঙ্গ করে সাব-লিজ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ইজারাদারের বিরুদ্ধে। এতে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানায়, দখলকৃত নদী দুটির চারদিকে নৌপথ বন্ধ করে যত্রতত্র মাছ ধরার অবৈধ ফাঁদ তৈরি করে রাখা হয়েছে। এতে প্রতিদিনই জেলে ও নৌকার মাঝিরা জড়াচ্ছেন বাগ্বিতণ্ডায়। নৌযান চলাচলের সময় মাছ ধরার জালের ক্ষতি দেখিয়ে নৌকার মালিকদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে জরিমানা।
জানা গেছে, জেলা প্রশাসন গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর বার্ষিক ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫০২ টাকায় বাংলা ১৪২৮ থেকে ১৪৩০ সন পর্যন্ত বিল আটউড়ি জলমহাল ইজারা দেয় নাসিরনগর ভিটাডুবি ধীবর সমিতির কাছে। ইজারার চুক্তিতে ২০টি শর্ত উল্লেখ করে সমিতিকে এসব মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সমিতির লোকজন চুক্তির তোয়াক্কা না করে লঙ্গন ও ধলেশ্বরী নদী দখল করে মাছ শিকার করছে।
চুক্তিনামায় উল্লেখ আছে, মা মাছ ধরা যাবে না। স্বাভাবিক নৌ-চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে- এমন কাজ করা যাবে না। অথচ নদীর মধ্যে শতাধিক জাল দিয়ে নৌচলাচলে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। জলমহাল কোনো অবস্থাতেই সাব-লিজ অথবা অন্য ব্যক্তিকে ব্যবহার করতে দিতে পারবে না।
ইজারাকৃত জলমহালের প্রবহমান প্রাকৃতিক পানি আটকে রাখা যাবে না এবং জলমহালের পাড়ে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে বনজ সম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে। তবে নদীর পাড়ে বৃক্ষরোপণ হয়নি। মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে নদীতে পোনা উৎপাদন, বিপন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ না ধরা ও ৯ ইঞ্চির ছোট মাছ না ধরা। কিন্তু বাস্তবে এসব শর্ত মানা হচ্ছে না।
সদর ও ভলাকুট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, নাসিরনগর মৌজার সাবেক ১২২২ দাগের ৯ দশমিক ৭ একর, নাসিরপুর মৌজার সাবেক ৬২৯ দাগের ৪ দশমিক ৭, ৬৬৯ দাগের ৫৭ দশমিক ৫৭ ও ৩৯১ দাগের ৬ দশমিক ৬০ একরসহ মোট ৭৮ দশমিক ৫৭ একর, ভলাকুট মৌজার সাবেক ৩১৭৯ দাগের ৭৫ দশমিক ৫০ একর, ৪৭৭১ দাগের ৩২ দশমিক ৯৮ একর, ২৫৯৪ দাগের ২৮ একর ও ২৫৯৫ দাগের ৭৫ দশমিক ৫০ একরসহ মোট ২১২ একর নদী দখল করেছে ইজারাদার।
স্থানীয়দের দাবি, উপজেলা সদর থেকে ভলাকুট, গোয়ালনগর ও চাতলপাড়ের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম লঙ্গন ও ধলেশ্বরী নদী। দুই নদীপথ দিয়েই চাতলপাড়, ভলাকুট ও গোয়ালনগরের ৮০ হাজার মানুষ অষ্টগ্রাম, ইটনা-মিঠামইন, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, লাখাই, হবিগঞ্জ ও ভৈরব যাতায়াত করেন। কিন্তু নদীর বিভিন্ন অংশ দখল করে মাছ শিকার করায় বিঘ্নিত হচ্ছে নৌ-চলাচল।
লঙ্গন নদীর টেকানগর থেকে ভলাকুটের খাগালিয়া ও কদমতলীর ধলেশ্বরী পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, নদীর বিভিন্ন অংশে অবৈধভাবে মাছ শিকারের জন্য অন্তত শতাধিক জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
নদীর অংশ লিজ নেওয়া মো. জামাল মিয়ার দাবি, ভিটাডুবি ধীবর সমিতির কাছে ভলাকুট থেকে খাগালিয়া পর্যন্ত লঙ্গন নদীর বিভিন্ন অংশ লিজ নিয়েছেন। প্রতিটি ঘের বাবদ ৪০ হাজার টাকা দেন। তাঁদের গ্রামের কান্দির অংশে ১২টি ঘের আছে। সবাই টাকা দিয়েই নদীতে মাছ ধরতে যায়। টাকা না দিলে কাউকে নদীতে নামতে দেয় না।
পাপোচন দাস বলেন, 'আমি গত বছর সমিতির কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা দিয়া লিজ নিছিলাম। এ বার সদর ইউনিয়নের গাংকুল পাড়ার সুশীল দাস নিছে ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়া।' তবে সুশীল দাসের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে চাননি।
নাসিরনগর ভিটাডুবি ধীবর সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাস দাবি করেন, নদীর অংশ সরকার তাঁদের ইজারা দেয়নি। তারা বিল ইজারা নিয়েছেন। তবে লঙ্গন নদীর আশপাশের খাস জায়গা লিজ দিয়েছেন স্থানীয়দের কাছে। বিষয়টি অবগত আছে।
মৎস্য আইনে নদী দখল ও মাছের স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়- এমন কাজ করা যাবে না। নদীর অংশ দখল নিতে পারবে না। ১৯৫০ সালের নদীরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী তা নিষিদ্ধ বলে জানিয়েছেন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শুভ্র সরকার। তিনি বলেন, নদীর বেশ কিছু জায়গায় দখলের সত্যতা পাওয়া গেছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, নদী দখলের বিষয়ে জেনেছি। দখলদারদের দখল ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। সাব-লিজ বাতিলসহ নদীর নৌপথে নৌ-চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়- এমন ঘের উচ্ছেদ না হলে লিজ বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।