ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

মশার এত কামড় আগে খাননি চট্টগ্রামবাসী

মশার এত কামড় আগে খাননি চট্টগ্রামবাসী

প্রতীকী ছবি

শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এডিস মশার কামড়ে এ বছর কাবু হয়েছেন রেকর্ডসংখ্যক মানুষ। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে এবার প্রাণহানি ও আক্রান্তের হার অতীতের সব সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগেও চট্টগ্রামে ১২ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬৬ জন। তবে ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল সাড়ে ৫ হাজারের বেশি। এটা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। মশার কামড়ে এবার প্রাণ গেছে শিশুসহ ৪১ জনের। এ মৃত্যুগুলো ঘটেছে বছরের শেষ চার মাসে।

অন্যান্য বছর অক্টোবরের পর থেকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কমতে থাকলেও এবারের চিত্র পুরোপুরি উল্টো। এ বছর নভেম্বর মাসেই রেকর্ড ২ হাজার ৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ মাসে এই রোগে প্রাণ গেছে সর্বোচ্চ ১৯ জনের।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এলাকার বাসিন্দাদের পাশাপাশি এবার মশার কামড়ে কাবু হয়েছেন চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার বাসিন্দারাও। প্রতিদিনই রেকর্ডসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত ও মারা গেলেও মশা মারতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি চসিক কর্তৃপক্ষ। তবে মশা মাড়তে কোটি টাকা খরচ করার দাবি সংস্থাটির। কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সঠিক তদারকির অভাবেই এ সংকট তীব্রতর হয়েছে বলে মত সংশ্নিষ্টদের। চিকিৎসকসহ সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। এরপর থেকে উপদ্রব কমতে থাকে। তবে এবার অক্টোবরের শুরু থেকেই রেকর্ডসংখ্যক রোগী শনাক্তের পাশাপাশি মৃত্যুও ঘটেছে। নভেম্বরে এসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। রেকর্ড মৃত্যু ও আক্রান্তের হার অব্যাহত ছিল ডিসেম্বরেও। এই অবস্থায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বলে দাবি তাঁদের।

মশার কামড়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চট্টগ্রামে বিদায়ী বছরের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেকর্ড ৫ হাজার ৪৩৯ জন মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২ হাজার ৮০৮ জন চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতালে এবং ২ হাজার ৬৩১ জন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। ৮০ শতাংশের বেশি রোগীকে দীর্ঘ সময় ধরে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে।

রোগীর চাপ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা দিতে দিশেহারা হয়ে পড়েন চিকিৎসকরা। এ কারণে চমেক হাসপাতালে তিনটি মেডিসিন ওয়ার্ড, দুটি শিশু ওয়ার্ডসহ পাঁচটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর গত পাঁচ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালে আক্রান্ত হয় মাত্র ৬৬ জন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৭৭ জন। এই দুই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোনো তথ্য দিতে পারেনি সিভিল সার্জন কার্যালয়। ২০১৯ সালে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ৫৪৮ জন। সে বছর মারা যান ৭ জন। ২০২০ সালে শুধু ১৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। ২০২১ সালে চট্টগ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সাড়ে পাঁচশ জন। সে বছর মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে ৮ জনের মৃত্যু হয়।

গ্রামাঞ্চলের মানুষও কাবু: চসিকের আওতাধীন ৪১টি ওয়ার্ডে রেকর্ডসংখ্যক বাসিন্দাদের পাশাপাশি এবার চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার বেশিরভাগ এলাকার গ্রামাঞ্চলের মানুষও মশার কামড়ে কাবু হয়েছেন। ১৫ উপজেলার মধ্যে এবার ৪টিতে বেশি বাসিন্দা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৭০ জন আক্রান্ত হয়েছে সীতাকুণ্ডে। এ ছাড়া কর্ণফুলীতে ১৫৭ জন, পটিয়ায় ১৩৩ জন এবং সাতকানিয়ায় ১০৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এই চার উপজেলায় অতীতে কোনো বছর এত সংখ্যক মানুষ মশার কামড়ে আক্রান্ত হননি।

আইইডিসিআরের 'হটস্পট': চট্টগ্রামে হঠাৎ করেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসেন প্রশাসন। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি পাওয়া বেশ কয়েকটি এলাকায় টানা কয়েকদিন সরেজমিন পরিদর্শন করেন ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি বিশেষজ্ঞ দল।

পরে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বেশকিছু এলাকাকে ডেঙ্গু বৃদ্ধির অন্যতম 'হটস্পট' হিসেবে চিহ্নিত করেন তাঁরা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আগ্রাবাদ, মা ও শিশু হাসপাতাল, হালিশহর, সিডিএ, ডবলমুরিং, বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল, পাহাড়তলী, দেওয়ানহাট, বড়পোলসহ আরও কয়েকটি এলাকা উল্লেখযোগ্য। তবে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা এসব এলাকায়ও মশা মারতে চট্টগ্রাম চসিকের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি বলে অভিযোগ বেশিরভাগ বাসিন্দার।

খরচ শুধু কাগজে-কলমে: মশার ওষুধ কিনতে ২০২১-২২ অর্থবছরে কাগজে-কলমে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে চসিক। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে কাগজে-কলমে মশা মারতে এত টাকা খরচ ও অনেক প্রস্তুতির দাবি করলেও ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের ঊর্ধ্বমুখী হার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। তাই মশা মারার এত টাকা যাচ্ছে কোথায়, তা নিয়ে বাসিন্দাদের মনে উঠছে নানা প্রশ্ন। সচিবালয়ে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে চট্টগ্রামে মশক নিধন কার্যক্রমের জন্য আরও বরাদ্দ বৃদ্ধির আবদার করেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, বছরের প্রথম আট মাসে ডেঙ্গুতে কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও শেষ চার মাসেই মারা গেছে রেকর্ড ৪১ জন। ডেঙ্গুর এমন অস্বাভাবিক আচরণে আমরা চিন্তিত।

ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, কাগজে-কলমে চসিক কোটি টাকা খরচ করলেও মশা মরছে না কেন? চসিকের জবাবদিহিতা না থাকায় এমনটি হচ্ছে। সংস্থাটি আন্তরিক ও সচেতন হলে এ বছর ডেঙ্গুতে এত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ও আক্রান্ত হতো না।

চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আবুল হাশেমের দাবি, মশা মাড়তে টানা কয়েক মাস ধরে বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হচ্ছে। এ জন্য লোকবলও বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি এলাকায় ওষুধ ছিটানো নিশ্চিত করতে সবাইকে কঠোরভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

×