ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বীরনিবাস নির্মাণেও এত অনিয়ম

বীরনিবাস নির্মাণেও এত অনিয়ম

নির্মাণকাজ শেষ করতে না করতেই ফাটল ও গর্ত সমকাল

নজরুল ইসলাম, স্বরূপকাঠি (পিরোজপুর)

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৩ | ২৩:৩৬

স্বরূপকাঠিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বীরনিবাস নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কার্যাদেশ পাওয়ার পর আড়াই বছরেও শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১০ ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে প্রথম পর্যায়ে ১২টি ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৭টিসহ মোট ৫৯টি বীরনিবাস বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এর মধ্যে একটির নির্মাণকাজও শেষ করেনি ঠিকাদার। এ বিষয়ে প্রশাসনকে বারবার জানানো হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।  

ভুক্তভোগীরা জানান, ৫৯টি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অনেকেই নিজেদের জীর্ণ কুটির ভেঙে ছাপরা ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন, যা এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অনেকে ভাড়া বাসায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

স্বরূপকাঠি উপজেলার ওই প্রকল্পের সদস্য সচিব ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মানস ঘোষ জানান, প্রথম পর্যায়ে ১২টি বীরনিবাস নির্মাণের জন্য লুনা এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ অনুযায়ী ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর অর্থাৎ ১৬ মাস আগেই কাজ শেষ করার কথা। দ্বিতীয় পর্বে ৪৭টি বীরনিবাস নির্মাণের জন্য গুচ্ছ প্রকল্পের মাধ্যমে সাতটি প্যাকেজ করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়; যা ২০২২ সালের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অর্থাৎ ৯ মাস আগেই শেষ করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি বাড়ির কাজও শেষ হয়নি।

এসব এলাকায় চলতি মাসের ১৮ থেকে ২২ তারিখ সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

সুটিয়াকাঠি ইউনিয়নের সুটিয়াকাঠি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকরুল আমীন কালুর স্ত্রী আসমা বেগম জানান, পুরোনো ঘর ভেঙে বাড়ির এক কোনে ছাপরা ঘর করে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে আড়াই বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রথম থেকেই ঠিকাদার নিম্নমানের ইট, খোয়া, বালু দিয়ে কাজ শুরু করলে উপজেলা প্রশাসনকে জানান। তৎকালীন ইউএনও তা সরিয়ে ভালো মানের মালপত্র আনার নির্দেশ দেন। ঠিকাদার কিছুটা ভালো ইট মিশিয়ে ফের ওই মালপত্র দিয়েই কাজ শুরু করেন। তিনি জানান, তাঁদের জন্য তৈরি করা ঘরটির ছাদ বাঁকা ও উঁচুনিচু, পানি জমে থাকে। জমাট হয়ে যাওয়া সিমেন্ট গুঁড়ো করে ছাদ ঢালাই করা হয়েছে। ঘষা দিলেই ঝরে পড়ে পলেস্তারা। বিষয়টি ইউএনওকে জানালে তিনি মালপত্র সরানোর নির্দেশ দেন। ঠিকাদারের লোকজন শুধু কাঠের দরজাগুলো নিয়ে গেছেন। তাও দুই মাস আগে। এরপর তাঁরা আর আসেননি।

স্বরূপকাঠি ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালেক জানান, নিম্নমানের মালপত্র দিয়ে কাজ করায় ঘরের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। দরজার কাঠও অত্যন্ত নিম্নমানের।

একই ইউনিয়নের অলংকারকাঠি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইছাহাক আলীর ছেলে বাদশা মিয়ার ভাষ্য– ঠিকাদার মালপত্র বহনসহ বিভিন্ন কাজ করে দেওয়ার জন্য তাঁকে চাপ দেন।  অপারগতা প্রকাশ করলে ঠিকাদার নিজেকে জেলার সরকার দলীয় নেতা বলে হুমকি দিয়ে দীর্ঘদিন কাজ ফেলে রাখেন। এতে সব গাঁথুনিতে শেওলা ধরে গেছে ও বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে।

পূর্ব অলংকারকাঠী এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ছোহরাব হোসেন বলেন, নিম্নমানের ইট-খোয়া দিয়ে কাজের ব্যাপারে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডারদের জানালে তাঁরা বারবার চেষ্টা করেও ঠিকাদারকে দিয়ে সঠিকভাবে কাজ করাতে পারেননি। মালপত্রের নমুনা তিনি মন্ত্রণালয়েও পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকার বীরনিবাস দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোভাবে বসবাসের জন্য। কিন্তু এগুলো যেন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।

ঘর বরাদ্দ পাওয়া সুটিয়াকাঠির বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ, গুয়ারেখার বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আব্দুর রবের ছেলে রাহাত ও কামারকাঠির বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সত্তার বলেন, সবক’টি ঘরের কাজের মান খুবই খারাপ, কোথাও কোথাও ঠিকাদার মালপত্র পরিবহন খরচ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে নিয়েছেন।

লুনা এন্টারপ্রাইজের পক্ষে উপঠিকাদার তরিকুল ইসলাম বাবু তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তাঁরা প্রাক্বলন অনুযায়ী কাজ করেছেন। রাজমিস্ত্রিদের কাজে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি হয়েছে, যা সংশোধনের চেষ্টা করছেন।

প্রকল্পের সদস্য সচিব ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মানস ঘোষ বলেন, অনেক বীরনিবাস নিয়ে অভিযোগ পেয়েছি। অনেকটা সংশোধন করিয়েছি। প্রাক্কলন অনুযায়ী কাজ না করা হলে বিল দেওয়া হবে না।

ইউএনও মাহাবুব উল্লাহ মজুমদার বলেন, অভিযোগ পেয়ে এরই মধ্যে অনেক প্রকল্পই পরিদর্শন করে সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছেন। সবক’টি প্রকল্পই সরেজমিন পরিদর্শন করে সঠিক কাজ বাস্তবায়ন করা হবে।

আরও পড়ুন

×