ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

বগুড়ায় ঝকঝকে সড়কে লুটপাটের প্রলেপ

বগুড়ায় ঝকঝকে সড়কে লুটপাটের প্রলেপ

বগুড়া শহরের দ্বিতীয় বাইপাস সড়কে শাখারিয়া মোড় এলাকায় নতুন রাস্তা তুলে মেরামত -সমকাল

লিমন বাসার, উত্তরাঞ্চল

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৩ | ১৮:০০

এক বছর আগেই হয়েছে সংস্কার। তাই সড়কটি ঝকঝকে, পরিপাটি। কোথাও নেই খানাখন্দ। তবু ভালো সড়কটি আবার মেরামতের আয়োজন। বগুড়া শহরের দ্বিতীয় বাইপাসে সড়ক বিভাগের এই ‘ভৌতিক’ কাজ দেখে অনেকেই বিস্মিত। এখন ‘কাজ দেখাতে’ কেটে ফেলা হচ্ছে সড়কের অনেক স্থান। সেখানে চলছে সংস্কার। ভালো সড়ককে নাজুক বানিয়ে তড়িঘড়ি কাজের কারণ ‘জুন ক্লোজিং’। এভাবে গোঁজামিলের মাধ্যমে লুটপাট করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কের যে অবস্থা, তাতে আগামী দুই বছর কাজ না করলেও চলত। এটা সরকারি টাকা অপচয় ছাড়া আর কিছুই না।
শহরের মাটিডালি বিমান মোড় থেকে বনানী লিচুতলা পর্যন্ত সড়কটি দ্বিতীয় বাইপাস সড়ক নামে পরিচিত। পাশেই মূল একটি বাইপাস সড়ক থাকার পরও যানবাহন চলাচল সহজ করতে বিএনপি সরকারের আমলে এটি নির্মাণ করা হয়।

বগুড়া সওজ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ডিবিসি (ড্রেন্স বিটুমিনাস কার্পেটিং) ওয়্যারিং কোর্সের (পিরিয়ডিক মেইনটেন্যান্স প্রোগ্রাম রোড) মাধ্যমে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। সড়কটি মেরামত করার জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর আগে সড়কটি ছিল অসংখ্য খানাখন্দে ভরা। মেরামতের পর পুরো সড়কটিই প্রাণ ফিরে পায়। ১৬ কিলোমিটার সড়কের কোথাও ভাঙা কিংবা ড্যামেজ ছিল না।

এর মধ্যেই ওই সড়কে ফের সংস্কারের পরিকল্পনা করে সড়ক বিভাগ। সেই অনুসারে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে ৮ দশমিক ৬ কিলোমিটার মেরামত কাজের জন্য ১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা খরচ করে আরেকটি ডিবিসি ওয়্যারিং কোর্স কার্যাদেশ দেওয়া হয়। সড়ক বিভাগের রংপুর জোনাল অফিস থেকে আহ্বান করা এই দরপত্রে অংশ নেয় সাত ঠিকাদার। ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কমে কার্যাদেশ পায় বরিশালের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোহিনুর এন্টারপ্রাইজ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোহিনুর এন্টারপ্রাইজ কার্যাদেশের কাজটি নিজেরা করছে না। নিয়ম ভেঙে কাজটি দেওয়া হয়েছে বগুড়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লুকনা বিল্ডার্সকে। তারা কার্যাদেশের প্রায় তিন মাস পর এই অর্থবছরের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কাগজ-কলমে কাজ শুরু করে। তবে এলাকাবাসী বলছেন, গত মে মাসে তারা কাজে হাত দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সওজের একটি সূত্র জানায়, সড়কের বর্তমান কাজটি অপ্রয়োজনীয়। এক বছর পরই একটি রাস্তা ফের মেরামত করার নিয়ম নেই। তবু নিয়ম ভেঙে একই কাজ দুবার করা হচ্ছে। এ ছাড়া সাড়ে আট কিলোমিটার রাস্তায় ক্রাক ও স্লাইড হওয়ার কথা উল্লেখ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সড়কটি সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এ কারণেই কার্যাদেশ পাওয়ার পরও ঠিকাদার তিন মাস বসে ছিল রাস্তা খারাপ হওয়ার আশায়। শেষ পর্যন্ত জুন চলে আসার কারণে বরাদ্দ ফেরত যাবে– এ শঙ্কায় তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করা হচ্ছে।

বগুড়া সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন, এ পর্যন্ত দুই দফায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ এক সপ্তাহ আগে ৩ কোটি টাকা বিল নিয়েছে। তারা বিলের চেয়ে কাজ অনেক বেশি করেছে। তিনি বলেন, এই কাজের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কারণ পুরো সড়কের অনেক স্থানে ক্রাক ও স্লাইড ছিল। হঠাৎ সেটা টের পাওয়া না গেলেও ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যেত। এই বর্ষায় যাতে সমস্যা না হয়, সে কারণে আগাম সতর্কতায় কাজটি করা হচ্ছে।

জানা গেছে, শর্ত অনুসারে এই সড়কে ঠিকাদারকে ১০ ধরনের কাজ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে এগ্রিগেট বেস টাইপ ১ (৮০ ভাগ পাথর, ২০ ভাগ বালু), ব্রিক অন এজিং (পাড় ইট দিয়ে খাড়াকরণ), সিলিং, বাইন্ডার কোড, ওয়্যারিং কোড, ট্যাপ কোড, প্রাইম কোড, সিল্ক পোস্ট, ট্রাফিক সাইন ও স্টুডাস (হলুদ সাইন)। সরেজমিন ওই সড়কে দেখা গেছে, অনেক স্থানেই ভালো রাস্তা মেশিন দিয়ে কেটে তুলে ফেলা হচ্ছে। এর পর সেই মালপত্র ক্রাশ করে ফের সড়কে ফেলে রোলার দিয়ে দাবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সড়ক বিভাগ এ পদ্ধতিকে বলছে কার্পেটিং কেটে রিফিল করে মিলকরণ। সড়কে স্থান ভেঙে ৪ ইঞ্চি থেকে ৫ ইঞ্চি গভীর করে এই কাটিং করা হচ্ছে। এর পর ট্যাগ কোড দিয়ে ৫০ মিলিমিটার বিটুমিন মিশ্রিত লেয়ার করার পর বাইন্ডার এই কাজ হবে। শেষে ৪০ মিলিমিটার আরও একটি বিটুমিন মিশ্রিত লেয়ার দেওয়া হবে।

বাইপাস সড়কে মানিকচক এলাকার বাসিন্দা কলেজছাত্র সুমন প্রামাণিক অভিযোগ করে বলেন, কোনো সমস্যা ছাড়াই ভালো রাস্তা কেটে ফেলছে। আবার রাতারাতি সেই রাস্তার কাজও হয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে লুটপাট ছাড়া আর কিছুই বলার সুযোগ নেই। আমরা এলাকার লোকজন মানা করেছিলাম। তবে ঠিকাদার ও সড়ক বিভাগের লোকজন শোনেনি।
পাশের জয় বাংলা মোড় এলাকার ব্যবসায়ী আকবর হোসেন বলেন, এ দুর্যোগের সময়ে সরকারের নাকি বিভিন্ন কাজে টাকার সংকট চলছে। বগুড়ার কাজটি দেখলে তা মনে হবে না। কোথাও গর্ত হলে বা দেবে গেলে আলাদা কথা ছিল। আমরা ভালো সড়কে এভাবে কাজ দেখে অবাক হয়েছি।

কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের হয়ে কাজ করা ঠিকাদার লুকনা বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মেহেদী হাসান রানা বলেন, সড়কে কিছু ভালো অংশ ছিল। সেখানে এখন কাজ না করলেও হতো। আমরা বিষয়টি সড়ক বিভাগকে বলেছি। তবে তারা কাজ করবে, এ জন্য সেসব অংশ কেটে কাজ করছি। তবে অন্য স্থানগুলোতে সমস্যা ছিল। মেরামতের পর তা ঠিক করা হয়েছে। মেহেদী হাসান রানা দাবি করেন, তিনি কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি হিসেবে কাজটি করছেন।

আরও পড়ুন

×