ঘটনা জানেন না চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন
চক্ষু শিবিরে গিয়ে চোখ হারালেন ২০ জন!

বকুল আহমেদ
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০১৮ | ১৯:৫০
কয়েক মাস আগে বাম চোখে ঝাপসা দেখতে থাকেন ৫০ বছরের দিনমজুর আহাম্মদ আলী। এক
পর্যায়ে তা এতই বেড়ে যায়, তিনি বাধ্য হন একটি এনজিও থেকে ক্ষুদ্রঋণ তুলে
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ
সেন্টারে যেতে। চোখ ভালো না হলে যে তার কর্মহীন থাকতে হবে। ৫ মার্চ তার বাম
চোখের ছানি অপারেশন করা হয়। বিপত্তি ঘটে তার পরই। ভুল চিকিৎসার কারণে এখন
চোখটিই তুলে ফেলতে হয়েছে তাকে।
শুধু চুয়াডাঙ্গার মোড়ভাঙ্গা গ্রামের আহাম্মদ আলী নন; ওই জেলার মোট ২০ জন
নারী-পুরুষের একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে ইম্প্যাক্ট হাসপাতালের চক্ষু শিবিরের
অপারেশনে। তাদের মধ্যে ১৯ জনের একটি করে চোখ তুলে ফেলতে হয়েছে। এরা সবাই
গরিব। তাই হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতেও ভয় পাচ্ছেন।
তারা বলছেন, তাদের প্রায় সবারই 'দিন আনি দিন খাই' অবস্থা। গ্রামে থাকেন;
শহরে এলেও সেখানে চলাফেরায় অভ্যস্ত নন। ইম্প্যাক্ট হেল্থ সেন্টারের
বিরুদ্ধে তারা লড়বেন কী করে? এমনকি স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ পর্যন্ত এসব
ঘটনা জেনেও নীরব।
সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক
মেমোরিয়াল কমুনিটি হেল্থ সেন্টারে তিন দিনের চক্ষু শিবিরের দ্বিতীয় দিন ৫
মার্চ ২৪ জন নারী-পুরুষের চোখের ছানি অপারেশন করা হয়। অপারেশনের দায়িত্বে
ছিলেন চিকিৎসক মোহাম্মদ শাহীন। তবে বাসায় ফিরেই ২০ জন রোগীর চোখে ইনফেকশন
দেখা দেয়। এসব রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ মার্চ
অপারেশনের পর ৬ মার্চ তাদের প্রত্যেককেই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
বাড়ি ফিরে ওই দিনই কারও বিকেলে, কারও সন্ধ্যায়, কারও বা রাত থেকে চোখে
জ্বালা-যন্ত্রণা ও পানি ঝরতে শুরু করে। পরদিনই তারা যোগাযোগ করেন
ইম্প্যাক্ট হাসপাতালে। তাদের তখন গুরুত্ব না দিয়ে কোনো রকম চিকিৎসা দিয়ে
বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে উঠলে ফের তারা
ইম্প্যাক্টে যান। সেখান থেকে তখন কয়েকজন রোগীকে স্থানীয় এক চক্ষু
বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। স্থানীয় ওই চক্ষু বিশেষজ্ঞ তাদের
উন্নত চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ
দেন। এদের মধ্যে চারজন রোগী নিজেদের উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত
স্বজনদের নিয়ে ঢাকায় আসেন। পরে ইম্প্যাক্ট থেকে ১২ মার্চ একসঙ্গে ১৬ জন
রোগীকে ঢাকায় নেওয়া হয়। ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ৫ মার্চের ওই অপারেশনের
ফলে এদের চোখের এত ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে যে, ১৯ জনের একটি করে চোখ তুলে ফেলতে
হয়েছে। ১৩ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে খামারবাড়ির ইস্পাহানী
ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে নয়জন এবং ২০, ২১ ও ২২ মার্চে
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের দৃষ্টি চক্ষু হাসপাতালে ১০ জনের একটি করে চোখ তুলে
ফেলতে হয়। এ ছাড়া হায়াতুন (৬০) নামে এক নারীর অপারেশন করা বাম চোখের
অবস্থাও ভালো নয়। ঢাকায় দ্বিতীয় দফায় অপারেশন করলেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসেনি
তার। তিনি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় নিজ বাড়িতে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
সর্বশেষ ২৫ মার্চ ইস্পাহানী ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে চোখ
তুলে ফেলতে হয় হানিফা বেগমের (৬৫)। ২৬ মার্চ সরেজমিন দেখা যায়, নিচতলার ১২৬
নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন তিনি। পাশে থাকা তার মেয়ে হালিমা বেগম সমকালের
সঙ্গে মায়ের চোখের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন,
ইম্প্যাক্ট হাসপাতালে ৫ মার্চ তার মায়ের বাম চোখের ছানি অপারেশনের পর ৬
মার্চ ছাড়পত্র দেওয়া হয়। তখন তাকে গ্রামের বাড়ি দামুড়হুদা উপজেলার সদাবরিতে
নেওয়া হয়। ওই দিন রাতেই তার মায়ের চোখে অসহনীয় যন্ত্রণা শুরু হয়। চোখ থেকে
পানিও ঝরতে থাকে। পরদিন ইম্প্যাক্টে যোগাযোগ করলে বলা হয়- ওষুধ খেলেই সব
ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় ৯ মার্চ মাকে ইম্প্যাক্ট
হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। সেখান থেকে তার মাকে চুয়াডাঙ্গার চক্ষু বিশেষজ্ঞ
ফকির মহাম্মদের কাছে রেফার করা হয়। রোগীর চোখের অবস্থা ভয়াবহ দেখে ওই
চিকিৎসক তাকে ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেন। ১২ মার্চ ঢাকার
খামারবাড়ির ইস্পাহানী ইসলামিয়া হাসপাতালে হানিফাকে ভর্তি করেন স্বজনরা। ওই
দিনই তার চোখের অপারেশন করা হয়। পরে আরও একটি অপারেশনের তারিখ দেওয়া হয়
সেখান থেকে। ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ায় ২৫ মার্চ অপারেশন করে চোখটি তুলে ফেলতে হয়।
এর আগে একই কারণে এই হাসপাতালে আরও আটজন রোগীর চোখ তুলে ফেলতে হয়।
ইস্পাহানী ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালের পরিচালক গাজী নজরুল
ইসলাম ফয়সাল ২৭ মার্চ সমকালকে বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জরুরি রোগী
ইসলামিয়া হাসপাতালে রেফার করা হয়। সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট থেকে
যেসব রোগী এসেছিলেন, তাদের অপারেশন করা চোখটিতে 'ইনডোপথালমাইটিস' নামের
জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছিল। অপারেশনের সময় অসতর্কতা, ব্যবহূত যন্ত্রপাতি
অপরিস্কার ও ওষুধসহ বিভিন্ন কারণে এ ইনফেকশন হতে পারে। তবে রোগীদের আরও আগে
ঢাকায় আনা হলে হয়তো চোখ বাঁচানো যেত।
সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ২০ রোগীর সবাই দরিদ্র। কেউ স্বজনের কাছে
ধারদেনা করে, কেউ বাড়ির ছাগল-মুরগি বিক্রি করে, কেউ বা এনজিও থেকে
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দৃষ্টিশক্তি ফেরাতে ভর্তি হয়েছিলেন চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট
হাসপাতালে। সেখানে অপারেশনের পরই তাদের চোখে ইনফেকশন হয়। পরে অপারেশন হওয়া
চোখ তুলে ফেলতে হয়। তবে ঢাকার হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা ব্যয় দিয়েই নিজেদের
দায় সেরেছে ইম্প্যাক্ট। যদিও সংশ্নিষ্টদের বিচার ও চিরদিনের জন্য অন্ধত্বের
ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।
'লোন তুলে চোখের অপারেশন' :নিজের ভিটেও নেই বৃদ্ধ আহাম্মদ আলীর। অন্যের
জমিতে দিনমজুরি করতেন তিনি। দুই মেয়ে এক ছেলে তার। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
১০ বছরের ছেলে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। আহাম্মদ
আলী বলেন, 'চিকিৎসা করার টাকা ছিল না। সমিতি (এনজিও) থেকে লোন তুলে ৫
মার্চে ইম্প্যাক্টে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে চোখের অপারেশন করি। আমার চোখ
ভালো হওয়া তো দূরের কথা, চিরদিনের জন্য এক চোখ কানা হয়ে গেল! আমি এখন কাজ
করতে পারি নে। লোনের টাকা দিয়ে সংসার চালাই, প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিই। এই
টাকা শেষ হয়ে গেলে কী করব বুঝতে পারছি না। আমি এর বিচার চাই।'
'আমার মায়ের চোখ ফেরত চাই' :চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার হারদির
হায়াতুনের (৬০) অপারেশন করা বাম চোখের অবস্থাও ভালো নয়। ঢাকায় দ্বিতীয় দফায়
অপারেশন করেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসেনি তার। ইম্প্যাক্টের পক্ষ থেকে তার
খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তার মেয়ে ফরিদা খাতুন। ফরিদা ২৬
মার্চ সমকালকে বলেন, 'ভালো করার জন্য আমার মায়ের বাম চোখ অপারেশন
করিয়েছিলাম। এখন চোখটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রক্ত পড়ছে। ডান চোখেও পানি পড়ছে।
দেখতে পাচ্ছেন না। যন্ত্রণায় কাঁদছেন সব সময়। আমরা গরিব মানুষ। কী করব
বুঝতে পারছি না। আমি আমার মায়ের চোখ ফেরত চাই।'
'ভিক্ষে করতে হবে, না হলে আত্মহত্যা' :অপারেশনের পর ডান চোখ তুলে ফেলতে
হয়েছে আলমডাঙ্গার স্বর্ণপট্টির চা দোকানি অবণি দত্তের (৭০)। তা ছাড়া বাম
চোখেও ঝাপসা দেখছেন। সমকালকে তিনি বলেন, 'জমিজমা নেই। চায়ের দোকান করেই
সংসার চালাতাম। এখন দোকান চালাতে পারি না। ছোটো ছেলে মাধব কাপড়ের দোকানে
কাজ করে যে টাকা পায়, তাতে সংসার চলে না। আমাকে ভিক্ষে করতে হবে, না হলে
আত্মহত্যা। ছেলে আর ক'দিন দেখতে পারবে?'
আরও যে ১৬ জনের একটি করে চোখ তুলে ফেলতে হয়েছে, তারা হলেন- আলমডাঙ্গা
উপজেলার নতিডাঙ্গা গ্রামের ফাতেমা খাতুন (৬০), পৌলবাগুন্দার খবিরন নেছা
(৫৭), বারাদি এনায়েতপুরের কৃষক খন্দকার ইয়াকুব আলী (৬২), রংপুর গ্রামের
ইখলাস আলী (৪০), ঘোলদাড়ির উষা রানী (৬৫), খাসকওরা গ্রামের লাল মোহাম্মদ
(৭০), নাইন্দিহাউলির কুটিয়া খাতুন (৪৫), দামুড়হুদা উপজেলার লক্ষ্মীপুর
গ্রামের তায়েব আলী (৬০), চিৎলা গ্রামের নবিছদ্দিন (৬০), বড়বলদিয়া গ্রামের
আয়েশা খাতুন (৭০), পারকেষ্টপুরের শ্রী মধু হালদার (৫০), মজলিশপুরের শফিকুল
(৫৫), কোমরপুরের গোলজান (৬০), চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গাইদঘাট গ্রামের
গোলজার হোসেন (৭০), আলোকদিয়ার ওলি মোহাম্মদ (৭০) এবং জীবননগর উপজেলার
শিংনগর গ্রামের আজিজুল হক (৭৫)।
ইম্প্যাক্ট কর্তৃপক্ষের দুঃখ প্রকাশ :এ ঘটনায় ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ
করেছেন ইম্প্যাক্ট হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাসিব মাহমুদ। ২৭ মার্চ তিনি
সমকালকে বলেন, ১৬ বছর ধরে তারা এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। এই প্রথম এ
ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল। এতে তারা মর্মাহত। তিনি বলেন, ৪, ৫ ও ৬ মার্চ চক্ষু
শিবির করে মোট ৬০ জন রোগীর চোখের ছানি অপারেশন করা হয় চুয়াডাঙ্গার
ইম্প্যাক্টে। ৫ মার্চ ২৪ জনের মধ্যে ২০ জনের চোখে ইনফেকশন হয়। ইম্প্যাক্টের
খরচে এসব রোগীকে ঢাকায় চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ইনফেকশনের কারণেই ১৯ জনের
একটি করে চোখ তুলে ফেলতে হয়েছে। হায়াতুন নামের আরেক রোগীর চোখের চিকিৎসা
চলছে।
ডা. হাসিব মাহমুদ বলেন, ১৩ মার্চ আইসিডিডিআরবি'র ল্যাবে পরীক্ষা করে জানা
গেছে, অপারেশনের সময় ব্যবহূত 'ট্রাইপেন ব্লু'তে একটা জীবাণু পাওয়া গেছে।
সেটি থেকে এই ইনফেকশন হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি। ইম্প্যাক্ট হাসপাতাল
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আইরিসের কাছ থেকে ট্রাইপেন ব্লু সংগ্রহ করে। বিষয়টি
আইরিসকে জানানো হয়েছে।
জানতে চাইলে আইরিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার সাহা সমকালকে বলেন,
ইম্প্যাক্ট থেকে বিষয়টি তাদের জানানো হয়েছে। ট্রাইপেন ব্লু তিনি ভারত থেকে
আমদানি করেন। আইসিডিডিআরবি'র দেওয়া রিপোর্ট ভারতে ম্যানুফ্যাকচারিং
কোম্পানির কাছে পাঠানো হয়েছে। এই রিপোর্টের সত্যতা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
ঘটনা জানেন না সিভিল সার্জন :চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম ২৭
মার্চ সমকালকে বলেন, ইম্প্যাক্ট হাসপাতালে অপারেশন করা রোগীদের এসব তথ্য
তিনি জানেন না। কেউ তার কাছে অভিযোগও করেননি। এক পর্যায়ে ইম্প্যাক্ট
হাসপাতালের পক্ষ নিয়ে তিনি বলেন, 'ইম্প্যাক্টের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
হয়ে কেউ সাংবাদিকদের কাছে তথ্য দিয়েছেন।' তাকে তখন জানানো হয়, ইম্প্যাক্টে
অপারেশন করা রোগীদের পরে ঢাকার দুটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তাদের চোখ
তুলে ফেলার তথ্য সমকালের কাছে রয়েছে। সিভিল সার্জন তখন বলেন, 'এত কিছু তো
জানা ছিল না। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন
তিনি।