ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

এক বছরে বন্ধ সহস্রাধিক খামার

এক বছরে বন্ধ সহস্রাধিক খামার

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০

গাইবান্ধায় গত এক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে সহস্রাধিক পোলট্রি খামার। হাঁস-মুরগির খাদ্য ও ওষুধের দাম বাড়তে থাকায় লোকসান গুনতে হচ্ছে খামারিদের। ফলে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন তারা।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধার সাত উপজেলায় ২ হাজার ৮২৭টি মুরগি ও হাঁসের খামার রয়েছে। এর মধ্যে ব্রয়লার ১ হাজার ৩টি, লেয়ার ১ হাজার ২৬৪টি ও হাঁসের খামার ৫৬০টি। এক বছর আগে কত খামার ছিল, তা জানাতে পারেনি তারা। তবে এ সময়ে সহস্রাধিক পোলট্রি খামার বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

খামার মালিকরাও জানান, গত এক বছরে সহস্রাধিক পোলট্রি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এক বছর আগে ৫০ কেজি ওজনের পোলট্রি খাদ্যের বস্তা বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায়। ছয়মাস আগে একই পরিমাণ খাদ্যের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা। এখন প্রতি বস্তা খাদ্য ২ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া এক বছর আগে যে ওষুধের দাম ছিল এক হাজার ৫০০ টাকা। ছয় মাস আগে এর দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। এখন সে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এর পর বেড়েছে শ্রমিকের মজুরিও।

অন্যদিকে একদিনের বাচ্চা থেকে শুরু করে ৩৫ দিনের বাচ্চা ফার্মে রাখলে প্রতিদিন খরচ হয় ২৩০ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে বাচ্চার দাম, ওষুধের দামসহ বিভিন্ন খরচ। খামারের ঘর তৈরিতে বাঁশ, কাঠসহ যেসব সামগ্রী ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর দামও দ্বিগুণ বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে বিদ্যুৎ খরচও। ফলে উৎপাদন খরচ না ওঠায় দিন দিন খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

গত মঙ্গলবার সদর উপজেলার বালুয়া গ্রাম, কুপতলা ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ভাগদরিয়া গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামের পোলট্রি খামারে গিয়ে দেখা গেছে, হাঁস-মুরগি নেই, পড়ে আছে ফাঁকা খামার। অনেক ব্যবসায়ী লোকসানের কারণে মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। তারা হাত গুটিয়ে বেকার বসে আছেন। ধারদেনা করে টিকে থাকা খামারের মালিকরা আশানুরূপ লাভের মুখ দেখছেন না। প্রায়ই লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।

খামার মালিকরা বলছেন, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

গোবিন্দগঞ্জের খামারি মালিক হাবিবুর রহমান আকন্দ জানান, গত বছর একদিনের বাচ্চার মূল্য ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বর্তমানে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বাচ্চা কিনতে হচ্ছে। সব কিছুর মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় বর্তমানে কেজিতে উৎপাদন খরচ ১৫০ টাকা। বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে ১৪০ টাকায়। এতে উৎপাদন খরচ তোলাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

গাইবান্ধা পৌর শহরের পোলট্রি খাদ্য ব্যবসায়ী টিটু মিয়া বলেন, ওষুধ ও খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় পোলট্রি শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। গাইবান্ধায় ভুট্টার উৎপাদন হলেও স্থানীয়ভাবে কোনো খাদ্য তৈরি হয় না। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বেশি দামে খাদ্য কিনতে হয়। ফলে ব্যবসায়ীদের তা বেশি দামেই বিক্রি করতে হয়। তা ছাড়া পোলট্রি খাদ্যের বেশিরভাগ উপাদান বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এসব কারণে ক্রমেই খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার বালুয়া গ্রামের ফরমান আলী তিন বছর আগে ৫০ হাজার টাকায় ১ হাজার লেয়ার মুরগির বাচ্চা কেনেন। ছয় মাস পর ডিম দেওয়া শুরু করে। প্রতিদিন গড়ে ৮০০ ডিম দিত। প্রতিটি ডিম আট টাকায় বিক্রি হতো। সেই হিসাবে তিনি দৈনিক ডিম বিক্রি করতেন ৬ হাজার ৪০০ টাকার। দৈনিক প্রায় ৪ হাজার ৮০০ টাকার খাদ্য লাগত। ওষুধ ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে দৈনিক আয় হতো ৫০০ টাকা। মাসিক আয় হতো ১৫ হাজার টাকা। ওষুধ এবং খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, ডিমের দাম ওঠানামা করায় ১০ মাস আগে সব মুরগি তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন।

ফরমান আলীর ভাষ্য– খামার বন্ধ করার পর থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাচ্ছেন। এখনও খামারের ঘর আছে। ভেতরে মুরগি নেই। পড়ে থেকে ঘরও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

রিঝি পোলট্রি খামারের মালিক ফরহাদ হোসেন। তাঁর খামারে ১ হাজার ১০০ লেয়ার মুরগি রয়েছে। দৈনিক গড়ে ৮০০টি ডিম দিচ্ছে। ডিমের দাম ভালো ছিল। প্রতিটি ডিম পাইকারি ১০ টাকায় বেচাকেনা হতো। খরচ বাদ দিয়ে মাসিক আয় হতো ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমান মুরগির ওষুধ ও খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া লাভের পরিমাণ কমেছে। অনেক সময় ডিমের দাম কমে গেলে লোকসান গুনতে হয়। এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই তাঁর জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে জানান ফরহাদ।

একই উপজেলার বেড়াডাঙ্গা গ্রামের মিজানুর রহমান বলেন, তাঁর খামারে প্রায় দেড় হাজার মুরগি ছিল। কিন্তু দফায় দফায় ওষুধ, খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হয়েছে। তাই গত বছর সব মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন।

একই কারণে খামার বন্ধ করেছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার গোলাপ মিয়া, আল আমিন মণ্ডলসহ আরও অনেকে। ফলে বেকার হয়ে পড়ছেন শ্রমিকরা। তবে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পেলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মাছুদার রহমান সরকার জানালেন, এক বছর আগে কত পোলট্রি খামার ছিল, তার সঠিক হিসাব জানা না থাকলেও এ সময়ে সহস্রাধিক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। তারাও পোলট্রি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে চান। খাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও মূলধনের অভাবে খামার মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকছে। পরে সেগুলো আবারও চালু হচ্ছে। তবে বিভিন্ন ব্যাংক স্বল্প সুদে ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে থাকে। খামারিরা যেন স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা পান, সে বিষয়ে সুপারিশ করবেন বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন

×