ঐতিহ্য
ফটিকছড়ির চা বাগানে ‘গরিবের এসি বাড়ি’

ফটিকছড়ির ধর্মপুর গ্রামে এখনও আছে পুরোনো দিনের মাটির ঘর। ছবি- সমকাল
ইকবাল হোসেন মনজু, ফটিকছড়ি
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৩ | ০৬:৪১
একটা সময় ফটিকছড়ির গাঁও-গ্রামে অসংখ্য মাটির ঘর ছিল। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে প্রায় প্রতিটি বাড়ি ছিল মাটির। চট্টগ্রামের ভাষায় এসব ঘরকে ‘মেইট্টা গুদাম’ বলা হয়। স্থানীয়রা নাম দিয়েছে ‘গরিবের এসি বাড়ি’। মাটির ঘর গরমকালে ঠান্ডা ও শীতকালে গরম থাকে। সময়ের সঙ্গে সমতল থেকে মাটির ঘর হারিয়ে গেলেও ফটিকছড়ির বিভিন্ন চা বাগানে এখনও দেখা যায় ঐতিহ্যের মাটির ঘর।
আঠালো মাটি কাঁদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া দেয়াল তৈরির মাধ্যমে উঠানো হেতা মেইট্টা গুদাম। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং দিয়ে তাঁর ওপর খড় বা টিনের ছাউনি দেওয়া হতো। মাটির ঘর অনেক সময় দোতলা পর্যন্ত করা হতো। একটি মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের তিন-চার মাস লাগত। গৃহিণীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন আল্পনা এঁকে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন।
এক সময় উপজেলার ধর্মপুর, বক্তপুর, পাইন্দং, ভূজপুর, কাঞ্চননগর এলাকায় অনেক পরিবার মাটির ঘর ছিল। ধর্মপুর ইউনিয়নের ইদ্রিস মিয়ার বাড়িতে চিরচেনা মাটির ঘর দেখা যায়। পাশাপাশি তিনটি মেইট্টা গুদাম এখনও পাড়ার শোভা বাড়ায়। ইদ্রিস মিয়া বলেন, ‘এই ঘর আমার দাদার ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পর আমার বাবা থাকতেন। পুরোনো স্মৃতি ধরে রাখতে এখনও মাটির ঘর রেখে দিয়েছি। তবে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে এখন অনেকে ইটের ঘর তৈরি করছেন, তাই ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে এমন মাটির ঘর।’
ধর্মপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক লিজা আকতার বলেন, ‘মাটির ঘর বসবাসের জন্য আরামদায়ক হলেও সময়ের প্রয়োজনে মানুষই মাটির ঘর ভেঙে স্বল্প জায়গায় অনেক লোকের বসবাসের জন্য পাকা দালান তৈরি করছেন। মাটির ঘর শীত-গরম উভয় মৌসুমে বেশ আরামদায়ক। বন্যা, ভূমিকম্প বা প্রবল ঝড় না হলে এসব ঘর শত বছর টিকে থাকে। এসব ঘর বেশি বড় হয় না। গৃহিণীরা নরম হাতের কোমল ছোঁয়ায় নিপুণভাবে কাদা মাটি দিয়ে ঘরের দেয়ালগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন।
এখন আর সেই মাটির ঘর তেমন চোখে পড়ে না। আমাদের বাড়ি এখনো মাটিরই আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাটির ঘর বন্যা ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে টেকসই হয় না। প্রতিবছর মাটির ঘরে খরচ না করে একবারে বেশি খরচ পাকা ঘর নির্মাণ করছেন মানুষ। তাই এখন মাটির ঘরের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় বিলুপ্তির পথে।’
উপজেলার রাঙ্গাপানি চা বাগানে দেখা যায়, বিভিন্ন টিলায় এখানো মাটির ঘর আছে। চা শ্রমিকরা পরিবার পরিজন নিয়ে সেই ঘরে বসবাস করেন। চা শ্রমিক সঞ্চয় দে, তারু মেন্ডি, রুপন দে বলেন, ‘আগের তুলনায় এখন মাটির ঘর খুব কম দেখা যায়। পরবর্তী প্রজন্ম মাটির ঘরের গল্পই শুনবে হয়তো।’
ভূজপুর ইউনিয়নের মাটির ঘরের কারিগর সাহেদ আলী বলেন, ‘মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের তিন-চার মাস লাগতো। মজুরি হিসেবে একটা ঘরের জন্য ২৫-৩০ হাজার টাকা নেয়া হতো। এখন আর মাটির ঘর কেউ নির্মাণ করে না। তাই আমাদেরও আগের মতো কাজ নাই। এখন অন্য পেশায় কাজ করছি।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সজল রায় বলেন, ‘মানুষ এখন বাস্তবমুখী ও আধুনিকতায় বিশ্বাসী। আয়-রোজগার বাড়ার কারণে মানুষ দিনদিন সৌখিন হয়ে উঠছে। এছাড়া এখন প্রচুর মানুষ বিভিন্ন দেশে গিয়ে সচ্ছল হয়েছেন। এ জন্য সচ্ছল ব্যক্তিরা তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে মাটির ঘরে থাকতে চান না। এ জন্য মাটির ঘর ভেঙে পাকা দালান নির্মাণ করছেন। এখন মাটির ঘর কমতে কমতে প্রায় বিলুপ্তির পথে। পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো জাদুঘরে দেখবে মাটির ঘর।’
- বিষয় :
- ঐতিহ্য
- ফটিকছড়ির চা বাগান
- মাটির ঘর
- এসি বাড়ি