ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

স্বাস্থ্যসেবার মাঠচিত্র (১০)

দিনাজপুরে রোগীদের সঙ্গে অভিনব ফাঁকি

রংপুর অঞ্চলের খবর

দিনাজপুরে রোগীদের সঙ্গে অভিনব ফাঁকি

বিপুল সরকার সানি, দিনাজপুর, মাহমুদুর রহমান, পার্বতীপুর ও জাহিদুল ইসলাম, হিলি

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ১৯:২৭

১০ ফেব্রুয়ারি। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর পৌনে ১টা। দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের আবাসিক সার্জন (অর্থোপেডিক্স) মিলন কুমার রায়ের কক্ষ খোলা। ভেতরে কেউ নেই। বাইরে অপেক্ষা করছেন পাঁচ-ছয়জন রোগী। এর মধ্যে লালবাগ থেকে চিকিৎসা নিতে আসা হুসনে আরা বেগম জানান, চিকিৎসক চা পান করতে গেছেন। ফিরে এসেই রোগী দেখবেন বলে তাকে জানানো হয়েছে। ওই চিকিৎসকের ওয়ার্ডবয় জানালেন, তার স্যার রোগী দেখতে অর্থোপেডিক্স বিভাগে গেছেন। তবে অর্থোপেডিক্স বিভাগে গিয়ে তাকে পাওয়া গেল না। সেখানকার ওয়ার্ডবয় বললেন, 'রোগী না থাকায় স্যার চা খেতে গেছেন।' রোগীরা অপেক্ষা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানোর জন্য। কিছুক্ষণ পরেই একজন চিকিৎসকের আগমন। এরপর ঘটল নাটকীয়তা। বেরিয়ে এলো সহজ-সরল রোগীদের সঙ্গে অভিনব ফাঁকির এক চিত্র। ডাক্তারের চেয়ারে বসলেন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সের অধীনে প্রশিক্ষণরত ডা. জিয়াউর রহমান। জানা গেল, ডা. মিলন ১৫ দিনের ছুটিতে রয়েছেন। এভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কক্ষে প্রশিক্ষণরত চিকিৎসক বসিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে শুনে রোগীরা হতবাক হলেন। শুধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নয়, দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নানা কায়দায় চিকিৎসকরা ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন। পার্বতীপুরের এক চিকিৎসক সাত বছর ধরে নিরুদ্দেশ। অন্যান্য উপজেলায় অনুপস্থিতির পাশাপাশি প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকায় প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছে না দিনাজপুরবাসী। ১০, ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন এসব চিত্র পাওয়া গেছে।

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল :১০ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টায় বহির্বিভাগের নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডা. শাকিলা আফরিন মিতির কক্ষ বন্ধ পাওয়া যায়। তার ওয়ার্ডবয় জানান, রোগী না থাকায় তার ম্যাডাম চলে গেছেন। দুপুর ১টার পর টিকিট দেওয়া হয় না। ফলে এ সময়ে রোগীও থাকে না। অথচ তখনও ১টা বাজেনি। ফাঁকিবাজির এই চিত্র শুধু বহির্বিভাগেই নয়, পুরো হাসপাতালেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসেন দিনে একবার- কোনো দিন দুইবার। সেটাও আবার সেবা নয়, বরং ইন্টার্ন চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখেই দায়িত্ব সারেন তারা। রোগীদের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই তাদের। রোগীপ্রতি দেড় থেকে ২ মিনিট সময় দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে দেড়-দুই মিনিট সময় দিলেও প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখতে তাদের কোনো ক্লান্তি নেই। পুরুষ ও নারী সার্জারি ওয়ার্ড, লেবার ও গাইনি ওয়ার্ডেও একই চিত্র। সেখানকার রোগীদেরও অভিযোগ চিকিৎসক নয়, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সেবা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের।

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এ হাসপাতালের চিকিৎসকের ১৭২টি পদের শূন্য রয়েছে ৯১টি। বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শাহজাহান বলেন, 'কোনো চিকিৎসক নির্ধারিত সময়ে রোগী না দেখে বাইরে থাকলে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে জনবল সংকট রয়েছে। একজন চিকিৎসককে রোগী সেবার পাশাপাশি একাডেমিক বিষয়টিও দেখতে হয়। যে কারণে হয়তো চিকিৎসকরা সেভাবে সময় দিতে পারেন না।'

পার্বতীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স :এ হাসপাতালে চিকিৎসকের ৩৪টি পদ থাকলেও দিনের পর দিন ৩০টিই শূন্য। কাগজ-কলমে চারজন চিকিৎসক থাকলেও ৪ লাখ মানুষের উপজেলায় চিকিৎসা চলছে আসলে তিনজন দিয়ে। রেবেকা রাজ্জাক নামে একজন চিকিৎসক সাত বছর ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। এক যুগ ধরে অপারেশন থিয়েটার বন্ধ। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি, কঠিন শিলা খনি, তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রেলওয়ে কারখানায় বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কিছুই করার নেই এই হাসপাতালের। মোটের ওপর যাচ্ছে-না তাই অবস্থা হাসপাতালের। এলাকাবাসীর দাবি, এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হোক।

হাকিমপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স :সার্জারি ও অ্যানেসথেশিয়ার চিকিৎসক না থাকায় দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর ধরে অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে। ১৩টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র তিনজন চিকিৎসক। ১১ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় সরেজমিন দেখা যায়, রোগীর দীর্ঘলাইন। চিকিৎসক সংকটে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে শুধু ব্যবস্থাপত্র নিয়েই চলে যাচ্ছেন।

চিকিৎসক সংকট চরমে :সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকের ১৫টির মধ্যে ১০টি, বিরল উপজেলায় ১৯টি পদের মধ্যে ১১টি, বোচাগঞ্জের ২৭টির মধ্যে ১৯টি, কাহারোলের ১৫টি মধ্যে ১০টি, বীরগঞ্জের ১৯টির মধ্যে ১৪টি, খানসামার ১৫টির মধ্যে ১১টি, চিরিরবন্দরের ২১টির মধ্যে ১৩টি, ফুলবাড়ীর ১৫টির মধ্যে ১০টি, বিরামপুরে ১১টি, নবাবগঞ্জে ১৩টি ও ঘোড়াঘাটের ১৩টির মধ্যে সাতটি পদ শূন্য রয়েছে।

দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল কুদ্দুছ বলেন, যে চিকিৎসকরা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে সব বিষয় মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। চিকিৎসকরা সেবা দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে এই পেশায় এসেছেন। তাই এর ব্যত্যয় হলে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

আরও পড়ুন

×