ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

স্বাস্থ্যসেবার মাঠচিত্র (১১)

শুধু রাউন্ডেই পাওয়া যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের

রাজশাহী অঞ্চলের খবর

শুধু রাউন্ডেই পাওয়া যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের

সৌরভ হাবিব, রাজশাহী

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ১৯:১১

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ৫৫০ রোগীর ডাক্তারে চলে আড়াই হাজার রোগীর চিকিৎসা। শুধু তাই নয়, সকালে একবার রাউন্ড দিয়েই চলে যান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এরপর হাসপাতাল চালান ইন্টার্ন ও ডিগ্রি নিতে আসা মধ্যম পর্যায়ের চিকিৎসকরা। তবে সব ওয়ার্ডে তাদেরও পাওয়া যায় না। ফলে সকালের রাউন্ডের পর কোনো নতুন রোগী এলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় পরদিন সকাল পর্যন্ত। এ কারণে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ওপর থাকে রোগীদের বাড়তি চাপ। তাদের ডিউটি করতে হয় দিনে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা। অতিরিক্ত চাপে থাকা ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের প্রায়ই অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে।

১৬ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডেই রোগীদের বাড়তি চাপ। ৫৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও এখানে প্রতিদিন রোগী ভর্তি হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার। ফলে ৫৫০ জন রোগীর জন্য বরাদ্দ ডাক্তার-কর্মচারী দিয়েই চালানো হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার রোগীর চিকিৎসাসেবা। ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি রোগী আসায় অধিকাংশ রোগীকেই ভর্তির পর আশ্রয় নিতে হয় হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রামেক হাসপাতালে ৫৫০ শয্যার হিসাবে ২৫৬ চিকিৎসকের পদ থাকলেও শূন্য রয়েছে ১৭টি। কিন্তু প্রতিদিন বিভিন্ন ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি হচ্ছেন প্রায় আড়াই হাজার। ফলে সকালে রাউন্ডের সময় চিকিৎসা দিয়ে গিয়েও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তেমন সময় দিতে পারেন না। দিনে একবার রাউন্ডের পর কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই ওয়ার্ডে ঢোকেন না। আর মধ্যম পর্যায়ের ডাক্তাররাও দুপুর আড়াইটার পর চলে যান। এরপর শুধু ইন্টার্ন চিকিৎসকনির্ভর হয়ে পড়ে উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতাল।

রামেক হাসপাতালের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে গিয়ে দেখা যায় রোগীর ছড়াছড়ি। পুরো বারান্দাসহ ওয়ার্ডের বেড ও মেঝেতে রোগীরা শুয়ে আছেন। কয়েকজন শুয়ে আছেন বাথরুমের সামনে। উৎকট দুর্গন্ধেও সেখানে তারা পড়ে আছেন। কয়েকজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে দেখা গেল রোগীদের চিকিৎসা দিতে।

এই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত নাটোরের সিংড়া উপজেলার সলেমান হোসেন বলেন, 'নয় দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বড় ডাক্তাররা সকালে একবার আসেন। এরপর কখনও সমস্যা বেশি হলেও বড় ডাক্তারদের আর পাওয়া যায় না।' হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সার্জারি ইউনিট-১-এ সকাল ১১টায় ভর্তি হন নওগাঁর ধামইরহাটের আবু তাহের। তিনি বলেন, রাউন্ডের পর ভর্তি হওয়ায় তাকে কোনো চিকিৎসকই দেখেননি। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ডাকা হলে তারা বলেছেন, আগামীকাল সকালে বড় ডাক্তাররা এসে দেখবেন।

হাসপাতালের ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে পেটব্যথা নিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ভর্তি হন জয়া নামের এক কিশোরী। দুপুর আড়াইটার দিকে দেখা যায়, জয়া পেটের ব্যথায় কান্নাকাটি করছেন। জয়ার মা জানান, তিনি এসে কোনো বড় ডাক্তার পাননি। ইন্টার্ন ডাক্তাররা রোগীর আলট্রাসনো করে আনার জন্য বলেছেন। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত তিনি আলট্রাসনো করাতে পারেননি। তাই পাননি চিকিৎসাও। এ কারণে জয়ার চিৎকারও থামছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ইন্টার্ন চিকিৎসক জানান, রাউন্ডের পর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আর আসেন না। ডিগ্রি নিতে আসা মিড লেভেলের কয়েকজন ডাক্তার আর ইন্টার্ন ডাক্তারাই হাসপাতাল চালান। তবে ডাক্তারের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি রোগী আসায় তাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। এ কারণে প্রায়ই রোগীর স্বজনদের সঙ্গে ইন্টার্ন ডাক্তারদের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। তাই প্রয়োজনীয় ডাক্তারের অভাব পূরণ করা খুবই জরুরি।

রামেক হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. সালেহ আনজুম সুজন বলেন, চিকিৎসকের তুলনায় রোগী অনেক বেশি। লোকবল, যন্ত্রপাতি, ওষুধ সবকিছুতেই ঘাটতি। বাড়তি চাপে থাকতে গিয়ে সব রোগীকে ঠিকমতো সময় দেওয়া যায় না। ফলে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে যায়। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে এই হাসপাতালকে এক হাজার বেড ঘোষণা করলেও বাস্তবে ৫৫০ বেডের বন্দোবস্ত রয়ে গেছে। শুধু নার্স আর রোগীর খাবার বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার, কর্মচারী, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বাড়ানো হয়নি। এ ছাড়া হাসপাতাল পরিচালনা কমিটি ঠিকমতো তদারক না করায় অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও রোগীরা তা পায় না। এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এনামুল হক বলেন, হাসপাতালে রোগীর তুলনায় ডাক্তার কম। শুধু নার্স আর খাবার বাড়ানো হলেও ডাক্তার-কর্মচারী বাড়ানো হয়নি। প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী ভর্তি হচ্ছেন, তার জন্য আরও ডাক্তার এবং বেড বাড়ানো জরুরি। হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা ঠিকমতোই হাসপাতালে আসেন।

দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে রামেক হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

×