ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

পঞ্চগড়ে চালু হচ্ছে দেশের তৃতীয় অনলাইন চা নিলাম কেন্দ্র

পঞ্চগড়ে চালু হচ্ছে দেশের তৃতীয় অনলাইন চা নিলাম কেন্দ্র

এক সময়ের পরিত্যক্ত ভূমি এখন চা চাষের সবুজে ভরে গেছে - সমকাল

পঞ্চগড় প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৩ | ১৪:২৭ | আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২৩ | ১৪:২৮

চট্টগ্রাম ও সিলেটের শ্রীমঙ্গলের পর দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র চালু হচ্ছে পঞ্চগড়ে। আগামী দুই সেপ্টেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রী এর উদ্বোধন করবেন। চা নিলাম কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হলে খরচ কমে যাবে তৈরিকৃত চা (মেড টি) পরিবহনে। সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। নিলাম কেন্দ্রে চায়ের উন্মুক্ত বেচাকেনায় কাঁচাপাতার ন্যায্যমূল্য পাবেন ক্ষুদ্র চা চাষিরা। আর এতে বদলে যাবে দেশের উত্তরের অর্থনীতি।

চা বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে ১৯৯৬ সালে চা চাষের পরিকল্পপনা হাতে নেওয়া হয়। ২০০০ সালে শুরু হয় ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষ। এরপর থেকে দিনদিন চা চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখানকার আহাওয়া আর মাটির উপযোগিতায় ২৩ বছরে চায়ের আবাদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি এখন চায়ের সবুজে ভরে উঠেছে।

সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়াসহ গোটা পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকায় দিনদিন বাড়ছে চা চাষের পরিধি, বাড়ছে উৎপাদন। গুণগত মান বিবেচনায় পঞ্চগড়ে উৎপাদিত চা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও বিক্রি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১০ হাজার ২৪০ একর জমিতে চা আবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে। ৮টি নিবন্ধিত ও ২০টি অনিবন্ধিত চা বাগান, সাত হাজার ৩৩৮টি ক্ষুদ্রায়তন এবং এক হাজার ৩৬৮টি ক্ষুদ্র চা বাগান গড়ে উঠেছে। পঞ্চগড়কে অনুসরণ করে চা চাষে এগিয়ে যাচ্ছে পাশের জেলা ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট। ইতোমধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ে এক হাজার ৪৫৭ দশমিক ২৯ একর, লালমনিরহাটে ২২২ দশমিক ৩৮ একর, দিনাজপুরে ৮৯ একর এবং নীলফামারীতে ৭০ দশমিক ৫৯ একর জমিতে চা আবাদ সম্প্রসারণ হয়েছে। সর্বশেষ উত্তরাঞ্চল চা চাষ প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়সহ পাঁচ জেলায় মোট ১২ হাজার ৭৯ দশমিক ৬ একর জমিতে ৩০টি চা বাগান এবং ৮ হাজারের বেশি ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান গড়ে উঠেছে। উৎপাদনের দিক থেকে চট্টগ্রামকে ছাড়িয়ে এই চা অঞ্চল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা চাষ অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

২০২১ সালে এই চা অঞ্চলে চা আবাদে জমির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৩৩ দশমিক ৯৪ একর। উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা। গত ২০২২ মৌসুমে এক কোটি ৭৭ লাখ ৮১ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। যা বিগত বছরের তুলনায় ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি বেশি এবং দেশের মোট উৎপাদনের ১৯ শতাংশ। বৈশ্বিক মহামারি উপেক্ষা করে জেলার ২৫টি চা কারখানায় উৎপাদিত চা নিলাম কেন্দ্রের মাধ্যমে ২৬০ কোটি টাকা মুল্যের চা বিক্রি করা হয়েছে। চা বাগান আর চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে গত ৪/৫ বছর ধরে চায়ের কাঁচা পাতার ন্যায্যমূল্য নিয়ে বিরুপ মনোভাব দেখা দেয় ক্ষুদ্র চা চাষিদের মধ্যে। চা কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের ফলে উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ তুলেন ক্ষুদ্র চা চাষিরা। একইসঙ্গে পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেন কারখানা ও বাগান মালিকসহ চা চাষিরা। এখানে দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হলে কাঁচা পাতার ন্যায্যমূল্য পাবেন বলে আশা করছেন চা চাষিসহ চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।

উপজেলা সদরের ক্ষুদ্র চা চাষি কুদরত-ই-খোদা মুন বলেন, তিন থেকে চার বছর ধরেই আমাদের চা উৎপাদনে লোকসান গুনতে হচ্ছে। কাঁচা চা পাতার ১৮ টাকা কেজি নির্ধারিত মূল্যেও আমরা কারখানায় বিক্রি করতে পারি না। বাধ্য হয়ে ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়। আবার বিভিন্ন অজুহাতে কাঁচা পাতার ওজন ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর্তন করে আমাদের মূল্য পরিশোধ করেন কারখানার মালিকরা। চা নিলাম কেন্দ্র চালু হলে আশা করি আমরা উপযুক্ত দাম পাওয়া যাবে।

জেলা শহরের ইনডিকো ব্রোকার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মাহাবুবা সেলিনা আক্তার জাহান বলেন, আমরা বাংলাদেশ চা বোর্ডের সব শর্ত পূরণ করে আমরা ব্রোকার হাউসের জন্য আবেদন করি। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে আমাদের আবেদন মঞ্জুরপূর্বক অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণসহ ইতোমধ্যে আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। নিলাম কেন্দ্র উদ্বোধন হলেই আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারবো বলে আশা করি।

পঞ্চগড় সাজেদা রফিক চা কারখানার পরিচালক মো. আরিফজ্জামান সুমন বলেন, আমাদের কারখানায় উৎপাদিত চা বিক্রির জন্য চট্টগ্রাম আর সিলেটের চা নিলাম কেন্দ্রে পাঠাতে হতো। এজন্য অতিরিক্ত পরিবহন খরচ লাগতো। পঞ্চগড়ে নিলাম কেন্দ্রটি চালু হলে কারখানা মালিকদের পরিবহন খরচ কমে যাবে। ভালো মানের কাঁচাপাতা ক্রয়ের মাধ্যমে ভাল মানের চা তৈরি করতে পারলে আমরা লোকাল অকশন মার্কেটে ভালো দাম পাব। এতে চা চাষিরাও কাঁচা চা পাতার ভালো দাম পাবেন বলে আশা করি।

পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ডের উন্নয়ন কর্মকর্তা কৃষিবিদ আমির হোসেন বলেন, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাও, নীলফামারিসহ উত্তরাঞ্চলে উৎপাদিত চা চট্টগ্রাম অথবা শ্রীমঙ্গলে পরিবহন না করে পঞ্চগড়েই কেনাবেচা করতে গত বছরের ২৩ অক্টোবর পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর কাজ শুরু করে বাংলাদেশ চা বোর্ড। দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র চালু করতে ওয়্যার হাউস, ব্রোকার হাউজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অনলাইন অ্যাপস তৈরিসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা নিলাম কেন্দ্র উদ্বোধনের দিন গুনছি।

জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দুই সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় নিলাম কেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনামতে, বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাসম সুজন অনলাইন নিলাম কেন্দ্রের উদ্বোধন করবেন। ইতোমধ্যে এখানে একাধিক ব্রোকার হাউজ, ওয়্যার হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, নিলাম কেন্দ্রটি চালু হলে গোটা উত্তরের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন আসবে।

আরও পড়ুন

×