সমন্বয়হীনতার খেসারত

চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৩ | ২২:০৮ | আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২৩ | ২২:০৮
সামান্য বৃষ্টিতেই যেন দুর্যোগের নগরীতে পরিণত হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর চট্টগ্রাম। জলাবদ্ধতায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সড়ক যোগাযোগ। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কলকারখানা। তালা মারতে হচ্ছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্থবিরতা নেমে আসছে ব্যাংক, বীমা থেকে শুরু করে দেশের প্রধান পাইকারি মোকাম চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে। নিম্নাঞ্চল ডুবে থাকছে কোমরপানিতে। নালা-নর্দমাতে পড়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। পাহাড় ধসেও যাচ্ছে প্রাণ।
বিশেষজ্ঞরা এমন দুর্যোগের নেপথ্যে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি গড়ে তোলা, সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করছেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘আগে পানির গতিপথে প্রতিবন্ধকতা ছিল না। বেশি বৃষ্টি হলেও পানি নেমে যেত ভাটিতে। এখন চট্টগ্রাম নগরীতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পানির গতিপথে বাধা তৈরি হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অদূরদর্শিতা দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে সমন্বয়হীনতা। আছে মানুষের অসচেতনতাও। পানির প্রবাহ আটকে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব কারণে বাড়ছে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি।’
কাজ হচ্ছে না মাস্টারপ্ল্যান ধরে
জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম নগরীর জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হয়। সেই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নগরীতে খাল ছিল ৭০টি। ৬২ বছর পরে এসে নগরীতে খালের সংখ্যা এখন ৫৭টি। অর্থাৎ হারিয়ে গেছে ১৩টি খাল। ১৯৯৫ সালে হয় আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান। সেটিতে নতুন করে চারটি খাল খনন ও পুরোনো খাল সংস্কারের কথা বলা আছে। কিন্তু এই পরিকল্পনা উপেক্ষা করে জলাবদ্ধতা নিরসনে ১১ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু সুফল মেলেনি এতটুকু। উল্টো দখল হয়ে গেছে নদীর দু’পাড়ের প্লাবন ভূমি, হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা। জলাধার দখল করে হচ্ছে আবাসিক এলাকা; উঠছে একের পর এক বহুতল ভবন।
বন্যার ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ‘যখন বৃষ্টি হয় তখন পানি খাল, ঝিরি হয়ে বিলে বা নদীতে গিয়ে মেশে। কিন্তু এই পানির প্রবাহ এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেবা সংস্থাগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে যে যার মতো করে। তাই এই অঞ্চলে জলাবদ্ধতার ক্ষতি প্রকট হচ্ছে। সামনে এমন দুর্যোগ আরও আসবে; বাড়বে ক্ষয়ক্ষতিও।’
কমে গেছে কর্ণফুলীর প্রশস্ততা
সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের সাবেক অধ্যাপক ইদ্রিস আলীর এক গবেষণা বলছে, ২০১০ সালের আগে শাহ আমানত সেতু এলাকায় কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল ৯০০ মিটার; যা এখন ৫২০ মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। নদীর প্রস্থ ৫০ থেকে ২৫০ মিটার পর্যন্ত কমে গেছে। ফলে নদীর দৈহিক ক্ষতি হয়েছে। একই সঙ্গে হারিয়ে গেছে নগরীর পানি নিষ্কাশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ১৩ খালও।
হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়
১৯৮১ সালে চবির ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলামের করা এক গবেষণা জরিপ অনুযায়ী, সে সময় চট্টগ্রাম নগরীতে জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৯৪১টি। ১৯৯১ সালে তাঁর করা আরেক জরিপ অনুযায়ী দেখা যায়, দশ বছরে নগরীর প্রায় ১৩ হাজার জলাশয় হারিয়ে যায়। আবার ২০০৬-০৭ সালে এক জরিপ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) জানায়, নগরীতে তখন জলাশয় ছিল মাত্র ৪ হাজার ৫২৩টি। বর্তমানে কী পরিমাণ জলাশয় আছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে।
চার দশকে বিলীন ১২০ পাহাড়
বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম, চট্টগ্রামের ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র এবং নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামের তিনটি সংগঠন বলছে, ৪০ বছর আগেও নগরীতে ২০০ পাহাড় ছিল। যার ৬০ শতাংশ ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। এক গবেষণার তথ্য দিয়ে তিন সংগঠন জানায়, চট্টগ্রামের বেশির ভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার, মতিঝরনা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে। ১৯৭৬ থেকে পরবর্তী ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয়। ১৯৭৬ সালে নগরীর পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২.৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪.২ বর্গকিলোমিটার। এ সময় ১৮.৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়; যা নগরীর মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ পাহাড় কাটা পড়েছে পাঁচলাইশে।
৬০ ফুটের খাল এখন তিন ফুটের নালা
নগরীতে জলাবদ্ধতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গত জুলাইয়ে এক সভায় চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ১৮ খালের মধ্যে পানি চলাচলে ২০ প্রতিবন্ধকতার চিত্র তুলে ধরেন। এর মধ্যে পতেঙ্গায় নির্মাণাধীন কর্ণফুলী টানেলের মুখে ৬০ ফুটের একটি খালকে তিন ফুটের নালায় পরিণত করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাঙ গ্রুপ ৪১ নম্বর একটি খাল এরই মধ্যে মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলেছে। সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীরা সরেজমিন পরিদর্শন করে এসব চিত্র ধারণ করেছেন বলে সভায় জানান রফিকুল ইসলাম।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন
নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ, চসিক ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর মধ্যে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএর মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। এর আওতায় নগরীর ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টির সংস্কার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চারটি প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তবুও জলাবদ্ধতা অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
- বিষয় :
- চট্টগ্রাম
- জলাবদ্ধতা
- সমন্বয়হীনতার খেসারত