নাটক সাজাতে লাশের পকেটে মোবাইল কানে হেডফোন

সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০২৩ | ১৯:৪১
১৯ বছরের তরুণ মো. রাসেল। ২০২০ সালের ১৭ জুলাই গাজীপুর শহরের টেক এলাকার গজারি বনের ভেতরে গাছে ঝুলছিল তাঁর লাশ। তখনও তাঁর কানে ছিল হেডফোন আর জামার পকেটে মোবাইল ফোনসেট। এই দৃশ্য দেখে যে কারও মনে হবে, বনের ভেতরে গাছে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন ওই তরুণ। প্রথমে তাই আত্মহত্যাজনিত ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলাও করে পুলিশ। তবে চিকিৎসক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর বদলে যায় সে ধারণা। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়, এটি ছিল হত্যাকাণ্ড। এরপর আত্মহত্যার মামলা হত্যা মামলায় রূপ নেয়। থানা পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পর সর্বশেষ এই মামলার তদন্ত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। তিন বছর পর এক তরুণীসহ চারজনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। তদন্তে ওঠে আসে পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক সাজাতে রাসেলের মরদেহ গাছে ঝুলিয়ে কানে হেডফোন ও পকেটে মোবাইল ফোনসেট রেখে দেওয়া হয়। নাদিরা বেগম নামে এক তরুণীর সঙ্গে দ্বিমুখী প্রেমের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব ঘিরে রাসেলকে খুন করা হয়েছিল। গাজীপুরের শ্রীপুরের রাজাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা শেখ আইনুদ্দিনের ছেলে তিনি।
মামলার চার্জশিট বিশ্লেষণ ও তদন্ত সূত্র জানায়, হত্যার শিকার রাসেলের ফুফাতো ভাই হলেন কাতারপ্রবাসী ফরিদ মিয়া। আর নাদিরা হলেন ফরিদের স্ত্রী। ২০২০ সালে স্ত্রীকে দেশে রেখে ফরিদ কাতার চলে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে রাসেলের সঙ্গে ‘গভীর’ সম্পর্কে জড়ান নাদিরা। পেশায় রাজমিস্ত্রি রাসেলের সঙ্গে নাদিরার প্রায় প্রতিদিনই ফোনে কথা হতো। আবার তারা পাশাপাশি বাড়ির বাসিন্দা। রাসেল তাঁর আরেক ফুফাতো ভাই রানার সঙ্গে গাজীপুরে একই বাসায় থাকতেন। নাদিরার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে তাঁকে প্রায়ই বলতেন রাসেল। কয়েক দিন পর রানাও গোপনে নাদিরার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ শুরু করেন। এক পর্যায়ে রানার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক তৈরি হয়। কিছুদিন পর স্বামীকে তালাক দেওয়ার জন্য নাদিরাকে চাপ দেন এবং তাঁকে বিয়ে করার কথা বলেন রাসেল। একপর্যায়ে তাঁর পরিবারকেও জানান। কী কী পরিকল্পনা নিয়ে রাসেল এগোচ্ছেন তার আদ্যোপান্ত রানার সঙ্গে শেয়ার করতেন। তবে রানা কখনও বলতেন না– তাঁর সঙ্গেও নাদিরার সম্পর্ক রয়েছে। অনৈতিক সম্পর্কের বিষয় এলাকায় জানাজানির পর রাসেলকে শায়েস্তা করার ফন্দি আঁটেন কাতারপ্রবাসী ফরিদের আপন ভাই কাউসার ইসলাম। রানার সঙ্গে এ ব্যাপারে নিয়মিত শলাপরামর্শ করেন তিনি। রাসেলকে শায়েস্তা করতে না পারলে এলাকায় তাঁর পরিবার মুখ দেখাতে পারবে না বলে জানান।
এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ সালের ১০ জুলাই নাদিরার মাধ্যমে রাসেলকে ফোন করিয়ে গজারি বনে ডেকে নেন। আগে থেকেই বনের ভেতরে উপস্থিত ছিলেন নাদিরা, রানা, কাউসার ও হেলাল নামে একজন। প্রথমে বনের ভেতরে নাদিরার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন রাসেল। কাতারপ্রবাসী স্বামীকে তালাক দিয়ে তাঁকে বিয়ে করার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। নাদিরার মন গলাতে এক পর্যায়ে কান্নাকাটি শুরু করেন। এর পরই তাদের সামনে গিয়ে হাজির হন বাকিরা। বনের ভেতরে তাদের দেখে হতচকিত হন রাসেল। নাদিরার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় তোলার পর তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে রাসেলের দুই পা চেপে ধরেন নাদিরার দেবর কাউসার। আর হেলাল গলা চেপে ধরেন। কিছু সময় পর রাসেল নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এর পর কাউসার দড়ি নিয়ে গাছের ওপর ওঠে রশির এক মাথা নিচে ফেললে রানা ও হেলাল মিলে রাসেলের গলায় দড়ি বেঁধে দেন। এর পর রাসেলের কাছে থাকা হেডফোন কানে গুঁজে দেওয়া হয়। আর রাসেলের মোবাইল ফোনটা বুক পকেটে রেখে দেন তারা, যাতে করে মানুষের মনে সহজেই বিশ্বাস জন্মায় ফোনে কথা বলতে বলতে আবেগে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। এ অবস্থায় রাসেলকে জড়িতরা যে যার মতো চলে যান। ঘটনার পাঁচ দিন পর এলাকার ইজ্জত আলী ওরফে টুকু মিয়া গরুকে ঘাস খাওনোর জন্য যাওয়ার সময় গজারি বনের ভেতর রাসেলের গলিত মৃতদেহ দেখতে পান। এর পর বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাসেলের পরিবারকে জানান তিনি।
তবে স্ত্রীর সম্পর্কের কথা জানলেও রাসেলকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি জানতেন না প্রবাসী ফরিদ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক হাফিজ উদ্দিন বলেন, রাসেলকে খুঁজে না পেয়ে তাঁর পরিবার ২০২০ সালের ১৪ জুলাই শ্রীপুর থানায় নিখোঁজ জিডি করেছিল। জিডির এক দিন পর স্থানীয়দের মাধ্যমে জানতে পারেন গজারি বনের ভেতরে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর লাশ মিলেছে। শুরুতে সবার ধারণা ছিল আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু। ময়নাতদন্ত ও পুলিশের তদন্তে ওঠে আসে– নাদিরাকে কেন্দ্র করে লোমহর্ষকভাবে রাসেলকে হত্যার পর লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
তিনি আরও জানান, হত্যার ঘটনায় জড়িত চারজনকেই গ্রেপ্তার হরা হয়। তবে তারা এখন জামিনে রয়েছেন। খুব শিগগির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে।