বাড়ি বলতে খড় ও টিনের তৈরি স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে মাটির দুটি ঘর। পাশে ছোট্ট একটি হেঁসেল। উঠানে মুরগির খোঁয়াড়। এর সঙ্গে লাগোয়া একটি অসমাপ্ত ছাপরাঘর। এই ছোট্ট উঠানে ১৫-২০ জন গৃহবধূ ব্যস্ত পুরোনো কাপড় জোড়া লাগিয়ে নকশিকাঁথাসহ নানা ধরনের পোশাক সেলাইয়ে। এ বাড়িরই গৃহবধূ শেফালী খাতুন প্রতিবেশী অন্য নারীদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন কাজ। ঈশ্বরদী উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের অজপাড়াগাঁ মানিকনগর মধ্যপাড়া গ্রামের নির্মাণ শ্রমিক মাসুম আলীর বাড়ির প্রতিদিনের চিত্র এটি।

পাঁচ বছর আগে মাসুম আলীর স্ত্রী শেফালী খাতুন পুরোনো শাড়ি, টুকরো কাপড় জোগাড় করে জোড়া লাগিয়ে শিশুদের নানা বাহারি জামা তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। শেফালী খাতুনের সাফল্যের গল্পটা এখান থেকেই শুরু। তার দেখানো পথ ধরে মানিকনগর ও জিগাতলা গ্রামের চার শতাধিক নারী এখন স্বাবলম্বী। তারা কেউ নকশিকাঁথা, কেউ বেডশিট, থ্রিপিস, শিশুদের পোশাক, পাপোশ তৈরি করে বিক্রি করছেন। গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি নিজেদের মতো সময় বের করে তারা এখন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।

এই গৃহবধূদের হাতে সেলাই করা নকশিকাঁথা শুধু ঢাকার বড় বড় শপিংমলেই নয়, যাচ্ছে ভারতের বাজারেও। শেফালী খাতুন জানান, প্রতি মাসে ১২শ' থেকে ১৫শ' পিস নকশিকাঁথা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মাজদিয়া বাজারে পাঠানো হয়। সেখানে ঈশ্বরদীর তৈরি নকশিকাঁথা বেশ জনপ্রিয়।

এই গ্রামের নারীরা সপ্তাহে হাজারখানেক নকশিকাঁথা তৈরি করছেন। প্রতিটি কাঁথার জন্য এক হাজার ২০০ টাকা মজুরি পান একেকজন নারী। এ ছাড়া নির্ধারিত নকশার বেডশিটের মজুরি ৭০০ ও ছোট কাঁথার মজুরি ৩০ টাকা হিসেবে মজুরি পেয়ে থাকেন তারা। প্রকারভেদে এসব কাঁথা প্রতিটি দুইশ' থেকে তিন হাজার টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়।

শেফালী শুধু নিজের জন্য নন, তার সঙ্গে কাজ করা এই চার শতাধিক নারীকে নিয়ে বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন 'বিত্তহীন মহিলা সমিতি' নামে একটি সমবায় সমিতি। এই সমিতিতে এসব নারী তাদের আয়ের কিছু অংশ জমা রাখেন। এ থেকে কেউ কেউ ফ্রিজ, টেলিভিশন বা সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনেন। এভাবেই কারও কুঁড়েঘরে ছনের পরিবর্তে টিন, মাটির ঘর হয়েছে পাকা। আবার কেউ কেউ জমানো টাকা দিয়ে জমিও কিনেছেন।

গৃহবধূ আফরোজা বেগম বলেন, আগে সারাক্ষণ শুধু সংসারের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। এখন কাঁথা সেলাই করে মাসে ৮-৯ হাজার টাকা উপার্জন করি। অভাবের সংসারে এখন সচ্ছলতা এসেছে।

গৃহবধূ রত্না খাতুন বলেন, আমি এ গ্রামের বউ হয়ে আসার কিছুদিন পর থেকেই শেফালী ভাবির সঙ্গে কাজ শুরু করি। এখন আমার সংসারে কোনো অভাব নেই। স্বামীর টাকার আশায় না থেকে এখন আমার আয়ে ইচ্ছামতো সংসারের প্রয়োজনীয় এটা-ওটা কিনতে পারি।

গৃহবধূ আঞ্জু বেগম বলেন, প্রথম প্রথম সেলাইয়ের কাজ শুরু করার সময় মনে হতো কী আর এমন হবে। এখন আমি একজন পুরুষ মানুষের চেয়ে কম উপার্জন করি না; বরং নকশিকাঁথা সেলাই করে আমি যা আয় করি, তা দিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে উপভোগ করতে পারছি।

গৃহবধূ রিতা বেগম বলেন, সংসারে অভাব-অনটনের কারণে আগে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারতাম না। এখন আমার রোজগারে তাদের পড়ালেখা করাচ্ছি। এটি আমার জন্য অনেক সুখের ব্যাপার। আসমা বেগম বলেন, আমি নকশিকাঁথা সেলাই করে যা আয় করি, তা দিয়ে সংসারে খরচ চালানোর পরও জমানো টাকায় ছাগল ও মুরগি কিনে লালন করছি। এ থেকেও বাড়তি আয় হচ্ছে।

চারশ' নারীকে যিনি সমাজে মর্যাদা নিয়ে পথ দেখিয়েছেন, সেই শেফালী খাতুন বলেন, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। একমাত্র ছেলে কলেজে পড়ছে। ছোট মেয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। তিনি বলেন, স্বামী নির্মাণ শ্রমিক। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা দূরের কথা, তার একার আয়ে সংসারই চলছিল না। পরে আমি নিজেই হাল ধরি সংসারের। এ কাজে বাড়ির সবাই আমাকে সাহস জুগিয়েছে। আমি এখন স্বপ্ন দেখি ঈশ্বরদীর এসব গ্রামের অন্তত ১০ হাজার গৃহবধূকে স্বাবলম্বী করতে। তাদের জন্য এ গ্রামেই গড়ে তুলতে চাই বড় কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান। যেখানে কাজ করে এই গ্রামের কেউ বেকার থাকবে না। গ্রামের প্রত্যেক গৃহবধূ হবেন স্বাবলম্বী।

শেফালী খাতুনের স্বামী মাসুম আলী সরদার বলেন, একবার বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালকে টাকা দিয়েছিলাম। বিদেশেও যেতে পারিনি, টাকাও ফেরত পাইনি। এখন আর বিদেশের স্বপ্ন দেখি না। স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করি। কলেজপড়ূয়া ছেলে শিহাব হোসেন ও স্কুলড়ূয়া মেয়ে কারিমা আক্তার মেঘলা জানায়, মায়ের এমন কাজে তারা গর্বিত।

স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন রুমি বলেন, আমার এই গ্রামের শত শত নারী শেফালী খাতুনের হাত ধরে এখন স্বাবলম্বী। এটি অত্যন্ত গর্বের বিষয়। তার হাত ধরে এই গ্রাম আরও এগিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

সলিমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের বলেন, সরকারি সহায়তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে এই গ্রামের নারীরা আরও দক্ষ হয়ে উঠবে। সলিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বাবলু মালিথা বলেন, আমার ইউনিয়নের একজন গৃহবধূর হাত ধরে চারশ' নারী বাংলার ঐতিহ্য নকশিকাঁথা তৈরির মাধ্যমে ঈশ্বরদীকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিহাব রায়হান বলেন, আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নই। আপনার মাধ্যমে আমি জানলাম। খুব শিগগির আমি ওই গ্রামে গিয়ে এসব নারীর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে তাদের উন্নয়নে কী করা যায়, ভেবে দেখব। প্রয়োজনে তাদের আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হবে।