
শুস্ক মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে হাওরের চিরচেনা রূপ। বর্ষায়
যেখানে পানি থৈথৈ করত, সেখানে আজ ধু-ধু প্রান্তর। ডুবন্ত জমিগুলো বুক
চিতিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। জেগে ওঠা সেই জমি সবুজে ভরে উঠেছে।
অপেক্ষাকৃত নিচু জমিগুলো প্রস্তুত হচ্ছে বোরো আবাদের জন্য। উঁচু জমিগুলো
পরিপূর্ণ হয়ে গেছে রবিশস্যের আবাদে। ধানের উৎপাদন খরচ অত্যধিক ও ঝুঁকিপূর্ণ
হওয়া এবং উপযুক্ত বাজারমূল্য না থাকায় এ ক্ষেত্রে হাওরের কৃষকের উৎসাহ আর
আগের মতো নেই। তারা এখন ঝুঁকেছেন শাকসবজি ও রবিশস্য উৎপাদনের দিকে। ভেসে
ওঠা হাওরের বালুময় ও কর্দমাক্ত জমিগুলোতে মুলা, আলু, বেগুন, ফুলকপি,
বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, টমেটো, খিরা, মিষ্টিকুমড়া, লালশাক,
ডাঁটাশাক, মাষকলাই, মরিচ, লাউসহ সব ধরনের খাদ্যের উৎপাদন হচ্ছে। ফলে বোরোর
বাম্পার ফলন এলাকা হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চল দিন দিন রবিশস্যের
নতুন ভান্ডারে পরিণত হচ্ছে।
করিমগঞ্জ উপজেলার হাওরসমৃদ্ধ সাগুলি, উত্তরগণেশপুর, নিয়ামতপুর; ইটনা
উপজেলার চৌগাঙ্গা, বরিবাড়ী; মিঠামইন উপজেলার কামালপুর, ইসলামপুর,
মহিষারকান্দি, বোরনপুর; অষ্টগ্রাম উপজেলার খয়েরপুর, আবদুল্লাহপুর,
বাঙালপাড়া; নিকলী উপজেলার ছাতিরচর, দামপাড়া, সিংপুরসহ ২৫ গ্রাম ঘুরে দেখা
যায়, এসব এলাকার উঁচু জমিগুলোতে শাকসবজি ও রবিশস্যের ব্যাপক চাষ হয়েছে।
এভাবে কয়েক বছর ধরে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন কৃষক। তাই তারা ধানের
পাশাপাশি শুস্ক মৌসুমে পতিত জমিতে রবিশস্যের আবাদে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। এ
মৌসুমেও তারা ভালো ফলন আশা করছেন। রবিশস্যের আবাদ করে একাধিক কৃষক তাদের
জীবনের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন।
ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা গ্রামের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ফরিদ মিয়া বর্গাচাষি
ছিলেন। কয়েক বছর ধরে তিনি নিজের সামান্য পতিত জমিতে শাকসবজি ও রবিশস্যের
আবাদ করে নিজের ভাগ্য বদলিয়েছেন। গ্রামের আরও অনেক কৃষক ফরিদ মিয়ার মতো
জীবনের মোড় ঘোরাতে সক্ষম হয়েছেন। এলাহী বক্স নামের একজন জানান, কৃষকরা
রোজগারের একটি সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছেন। ১০ বছর আগে এ অবস্থা এখানে ছিল
না।
মহিষারকান্দি গ্রামের রুহুল মিয়া, কাঞ্চন মিয়া; ইটনা উপজেলার শিমুলবাগ
গ্রামের মোমেন হোসেনসহ অন্তত ১০-১২ সবজি ব্যবসায়ী তাদের অতীত জীবনের দুঃখের
কাহিনি জানিয়ে বর্তমান সচ্ছলতার পেছনের কথা বলেন। তারা বলেন, হাওরে একফসলি
জমিতে সবজি উৎপাদন হবে, তা তাদের বাপদাদারা কল্পনাও করতেন না।
ব্যবসায়ীরা জানান, হাওর থেকে পাইকারি দরে কিনে সাধারণত প্রতি সপ্তাহে তিনটি
ট্রাকবোঝাই সবজি ঢাকার কারওয়ান বাজারে পাঠানো হয়। শিমুলবাগ গ্রামের
সবজিচাষি বরকত মিয়া বলেন, তাদের সবজি চাষ দেখে কাজলা, কৃষ্টপুর, চন্দ্রপুর,
গজারিয়া, তাড়াইল, মাগরি, বর্মা প্রভৃতি গ্রামেও চাষের পরিধি বেড়েছে।
সবজিচাষিরা আরও জানান, একফসলি জমিতে বোরো ধান আবাদ ও মাড়াইয়ের পরপরই বর্ষা
শুরু হয়। এ সময় হাওরে বসবাসরত একটি বড় জনগোষ্ঠী মাছ শিকারে ব্যস্ত থাকে।
প্রায় ছয় মাস তাদের বেকার থাকতে হতো। কার্তিক মাসে হাওর থেকে পানি নেমে
যায়। উজান এলাকায় এ সময় সবজি চাষ দেখে হাওরের কোনো কোনো এলাকার চাষি পানি
নামার পরপরই সবজি চাষের উদ্যোগ নেন।
বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের
পরামর্শক্রমে চাষিরা 'গ্রামভিত্তিক সবজি উৎপাদন কমিটি' গড়ে তুলে সবাইকে
উদ্বুদ্ধ করেন। এভাবেই হাওরে শুরু হয় সবজিবিপ্লব।
তাড়াইলের আনোয়ারপুর গ্রামের মহসিন আলী জানান, হাওরে সবজির উৎপাদন হবে, এটা
তাদের ধারণার বাইরে ছিল। আগে নৌকায় করে শহর থেকে হাওরে সবজি আসত। এখন হাওর
থেকে শত শত নৌকায় সবজি যাচ্ছে শহরে।
চৌগাঙ্গার কৃষক সবুজ মিয়া বলেন, তিনি এবার ৩০ শতাংশ জমিতে মুলা চাষ করে ১০
হাজার টাকা মুনাফা করেছেন। মুলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই জমিতে বোরো ধান
আবাদ করেছেন। একই গ্রামের আসাদুজ্জামান জানান, তার ৩০ শতাংশ জমিতে বেগুন,
মুলা ও রসুন চাষ করেছেন। জমিতে উৎপাদিত সবজি দিয়েই তার সারাবছর চলে যায়।
একই গ্রামের রাহেলা খাতুন দুই একর জমিতে সবজি চাষ করে ৫০ হাজার টাকা মুনাফা
করেছেন। ইটনা উপজেলার শিমুলবাগ গ্রামের আকলিমা আক্তার জানান, সবজি চাষ
তাদের জীবনে সচ্ছলতা এনে দিয়েছে। মিঠামইন উপজেলার রহমতপুর গ্রামের লুৎফা
বেগম সামান্য জমিতে সবজি চাষ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন।
ইটনা উপজেলার শিমুলবাঁক গ্রামে ৩৮৯টি পরিবার বসবাস করে। তারা সমিতির
মাধ্যমে হাওরে দুই বছর ধরে সবজি চাষ করছেন। গ্রামের অধিকাংশ লোক অতিদরিদ্র
শ্রেণির হলেও বর্তমানে সবজি চাষ করে তারা সচ্ছল। শিমুলবাঁক গ্রামের ইউনিয়ন
পরিষদ সদস্য দানেশ আকন্দ জানান, বাস্তবতা হচ্ছে হাওরে নীরব সবজিবিপ্লব শুরু
হয়ে গেছে।
সবজি সমিতির সভাপতি কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
সবজি চাষে গ্রামের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে। তাই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। মিঠামইন
উপজেলার রহমতপুর গ্রামে মোট ৯০টি পরিবার। এবার তারা ১০ হাজার ৪০২ কেজি সবজি
উৎপাদন করেছে। মিঠামইন উপজেলার ঢাকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর
রহমান জানান, দিন দিন সবজি চাষ ও রবিশস্য চাষের পরিধি বাড়ছে।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শরীফ কামাল জানান, কিশোরগঞ্জের
আটটি হাওর ও আংশিক হাওর উপজেলার প্রায় ২৫০টি গ্রামে সবজি উৎপাদন হচ্ছে। ২০
হাজার দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের আড়াই লক্ষাধিক মানুষ এতে উপকৃত হচ্ছে।
ইটনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুল হাসান জানান, সবজি চাষে
হাওরের চাষিদের সব ধরনের সহায়তা দেব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মতিউর রহমান জানান, হাওরে
সবজি উৎপাদন অনেকটাই নীরব কৃষিবিপ্লব। কৃষকরাই আমাদের বাজার ব্যবস্থার
সার্বিক চিত্র বদলে দিতে পারে। হাওরে সবজি চাষ তার প্রমাণ। ১০ বছর আগে
এমনটি হয়নি। আগামী সবজি মৌসুমে আরও বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন