উচ্চতা তার ৩৩ ইঞ্চি। জন্ম থেকেই এই অস্বাভাবিক গঠন। পা দুটিও অচল, হাঁটতে পারে না তাই। তেমন শক্তি নেই হাতেও। বাবা-ভাইসহ পরিবারের লোকজনের কোলে তার প্রতিদিনের চলাচল। বাবার কোলে এসে পরীক্ষা দিচ্ছে সে এসএসসি।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে এমনই এক অদম্য পরীক্ষা দিচ্ছে এবার। নাম ফারজানা ইয়াসমিন মনি। নাগেশ্বরী আদর্শ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন্দ্র তার। প্রাথমিক সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ ৪ পয়েন্ট পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। গাগলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক শাখায় পরীক্ষা দিচ্ছে সে।

নাগেশ্বরী পৌরসভা এলাকার কুটি বাগডাঙ্গা এলাকার ফরমান আলীর একমাত্র মেয়ে ফারজানা ইয়াসমিন মনি। দুই ভাইয়ের ছোট বোন শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও পরিবারের সবার নয়নের মণি সে। বাবা উপজেলার উত্তর পন্তাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।

মনির বাবা জানান, ২০০৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মনির জন্ম। জন্মের সময় শারীরিক চেহারা কিছুটা অস্বাভাবিক থাকলেও রূপবতী হবে সে, বলেছিল অনেকে। তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই তার অঙ্গহানি; হাঁটতে পারে না। নিজের কোনো কাজই তেমন করতে পারে না সে। তাকে ভাত তুলে খাওয়ান তার মা।

বড় দুই ছেলে পড়ালেখা করে দেখে পড়তে যেতে চায় মনি। পরে ভর্তি করে দেন নিজের কর্মস্থল পন্তাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নিজের কোলে করে মোটরসাইকেলে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে যান। আবার ছুটি শেষে একইভাবে কোলে করে এনে মোটরসাইকেলে বসিয়ে নিয়ে আসেন বাড়িতে। এভাবে দিন দিন পড়ার আগ্রহ দেখে মন ভরে যায় বাবার। ২০১৪ সালের সমাপনী পরীক্ষায় এ-গ্রেড পেলে খুশি হয় সবাই। পরে ভর্তি হয় গাগলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানে তো তার বাবা নিয়মিত যান না। তাকে আনা-নেওয়া কে করবে, এমন সংশয় তৈরি হয়। পরে তার চাচা শফিউর রহমান, বড় ভাই আবদুর রাজ্জাকসহ যে যেদিন পারতেন, পৌঁছে দিতেন স্কুলে। আবার ছুটির পর নিয়ে আসতেন। এভাবে সে জেএসসিতেও এ-গ্রেড অর্জন করে।

এবারও গাগলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে মনি। পরীক্ষা শুরুর আগে তার বাবা মোটরসাইকেলে করে নিয়ে এসে কেন্দ্রের বাইরে থেকে তাকে কোলে করে কক্ষে বসিয়ে দেন। আবার পরীক্ষা শেষ হলে নিয়ে যান। এভাবে চলছে তার পরীক্ষা।

শারীরিক এ অবস্থাতেও আকাশছোঁয়া স্বপ্ন মনির। সে জানায়, পরীক্ষা ভালো হচ্ছে। আশা করি, ফল ভালো হবে। আরও পড়ব। ইচ্ছে আছে ইঞ্জিনিয়ার হব। সেইসঙ্গে ভালো মানুষ হতে হবে আমাকে। এভাবে চলতে এখন আর কষ্ট হয় না। পরিবারের সবার আদর ভুলিয়ে দেয় সবকিছু। সে বলে, 'পরিবারের সবাই আমাকে সাপোর্ট করে। আমি নিজে কিছু করতে পারি না। মা আমাকে ভাত তুলে খাওয়ান। সবাই খুব কষ্ট করে।'

চাচা শফিউর রহমান বলেন, 'ওর আগ্রহ আমাদের বেশি কর্তব্যপরায়ণ করে তুলেছে। সে মানুষ হবে অন্য সাধারণের মতো, এটাই চাই।' বড় ভাই আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'তাকে কোলে করে স্কুলে আনা-নেওয়া করছি আমরা। তার ফল যখন ভালো হয়, তখন ভালো লাগে।' মা রাবেয়া বেগম মেয়ের বিষয়ে কথা বলতে না চাইলেও বলেন, 'সবাই যেন দোয়া করেন। আমার মেয়ের মনের আশাটা পূরণ যাতে হয়।'

মনির বাবা ফরমান আলী বলেন, 'আমি স্কুলশিক্ষক সুবাদে তার পড়ালেখাটা শুরু করাতে পেরেছি। এখন আর কষ্ট হয় না তার জন্য। এখন স্বপ্ন দেখি তাকে নিয়ে। সেও যেন পড়ালেখা শেষে তার অধিকারমতো একটি চাকরি পায়।' মেয়ের কথা বলতে গিয়ে অনেকটা গলা ধরে আসে তার। চোখ মুছে বলেন, 'মেয়ের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করি আল্লাহর কাছে। তার সুখের জন্য কাঁদি।'

তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গাগলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউনুছ আলী বলেন, 'ফারজানা ইয়াসমিন মনি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও স্কুলে লেখাপড়ায় ছিল মনোযোগী। অনেক স্বাভাবিক শিক্ষার্থীর চেয়েও সে ভালো ফল করে আসছে। আশা করি, এসএসসিতেও ভালো ফল করবে।'

নাগেশ্বরী আদর্শ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, অন্য সবার মতো পরীক্ষা দিচ্ছে মনি। তার জন্য কেন্দ্রের বেঞ্চ উঁচু হয়ে গেছে। একটু কষ্ট করে লিখতে হচ্ছে তাকে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ও ওই পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিব মোশারফ হোসেন বলেন, 'যতবার ওই কক্ষ পরিদর্শন করতে গিয়েছি, দেখেছি মনি নামের খুদে মেয়েটি বেশ মনোযোগ দিয়ে লিখছে। এ ছাড়া নিয়ম অনুযায়ী তার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে পরীক্ষায়।'