
শিক্ষার্থীদের মাঝে জলবায়ু সচেতনতা বিষয়ক পেপার কাটিং বিলি করছেন জাহাঙ্গীর খন্দকার-সমকাল
জনসমাগম দেখলেই সেখানে ছুটে যান তিনি। ছুটে যান স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে। উপস্থিত হন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের কাছে। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে কোনো আয়োজনের খবর পেলেও অকুস্থলে ছুটে যান তিনি। সঙ্গী তার একটি ব্যাগ। তাতে ভর্তি দেশি-বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত বৈশ্বিক জলবায়ুর উষ্ণতা নিয়ে খবরের কাটিং ও তার ফটোকপি। এসব কাটিং-ফটোকপি তুলে দেন মানুষের হাতে। মানুষকে বোঝান জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি। তুলে ধরেন পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের করণীয়।
এভাবে জলবায়ু নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে গত ১০ বছর ধরে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আশুগঞ্জ উপজেলার মো. জাহাঙ্গীর খন্দকার। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বীরসেনানী পেশায় একজন প্রকৌশলী।
পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্ট, ব্যাপক হারে কার্বন নিঃসরণসহ বিভিন্ন মানবসৃষ্ট কারণে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরূপ প্রভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে যাচ্ছে খোদ মানবসভ্যতাই। সমুদ্রে বিলীনের আশঙ্কায় পড়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সাগর-তীরবর্তী অঞ্চল। এ আশঙ্কাজনক অবস্থা ভাবিয়ে তুলেছে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর খন্দকারকে। তাই তিনি মানুষকে জলবায়ু সম্পর্কে সচেতন করতে ১০ বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। প্রথমদিকে লোকজন তাকে হেসে উড়িয়ে দিলেও এখন সবাই সমর্থন করছেন, দাঁড়িয়ে তার কথা শুনছেন, সমর্থন জানাচ্ছেন তার কর্মকাণ্ডে।
আশুগঞ্জ উপজেলার চরচারতলা গ্রামের প্রয়াত বদরুর রহমান খন্দকার ও রাজিয়া বেগম দম্পতির সন্তান জাহাঙ্গীর। ১৯৬৫ সালে এসএসসি শেষে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় পরীক্ষা না দিয়েই চলে যান তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। ভর্তি হন করাচি সুইডিস টেকনোলজি ইনস্টিটিউট অব পাকিস্তানে। সেখান থেকে প্রকৌশল ডিপ্লোমা অর্জন শেষে ১৯৭০ সালে ইসলামাবাদে অবস্থিত একটি কোরিয়ান টেলিকম কোম্পানিতে মেকানিক্যাল বিভাগে চাকরি নেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশমাতৃকার টানে তিনি লোভনীয় বেতনের সেই চাকরি ছেড়ে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন ৩ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন অঞ্চলে। দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধা ঐক্যজোট।
পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহ-সম্পাদকের। পরে নানা কারণে তিনি এ পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন এবং চাকরি নেন আশুগঞ্জ সার কারখানায়। কিছুদিন পর উচ্চতর কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসে চলে যান। ফিরে এসে আবার যোগ দেন আশুগঞ্জ সার কারখানায়। সেখান থেকে পরে ঘোড়াশাল সার কারখানায় কিছুদিন চাকরি করার পর সৌদি আরবে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাকরি নিয়ে চলে যান। তবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ নানা কারণে ১৯৮১ সালে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশে চলে আসেন। তবে স্ত্রী রোকেয়া বিলকিসের চাকরি থাকায় তাকে সংসার নিয়ে ভাবতে হয়নি।
নিজের সংসারের জন্য না ভাবলেও তিনি ভাবছেন মানুষের কথা। তাইতো ২০০৯ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতাবাবদ পাওয়া অর্থ ব্যয় করে জলবায়ুবিষয়ক প্রতিবেদন ছাপা হওয়া দেশিবিদেশি পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করছেন, ফটোকপি করে বিলি করছেন জনে জনে, যাতে মানুষ সচেতন হয়। করছেন ছোট আকারে সমাবেশ-মানববন্ধন।
জাহাঙ্গীর খন্দকার বলেন, যখন শুরু করেছিলাম, তখন খুব একটা সাড়া পেতাম না। এখন অনেকে তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন, আলোচনা শুনতে চাইছেন। তার বিশ্বাস, বাংলাদেশসহ বিশ্বের মানুষ একদিন জেগে উঠবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় স্কুলশিক্ষার্থী মাইশা, আছমা, কাসেম, রনিসহ অনেকে জানান, তিনি প্রায়ই আমাদের স্কুলে আসেন এবং আমাদের পত্রিকার ফটোকপি দেন। জলবায়ু নিয়ে কথা বলেন। আমরা তার কাছে জলবায়ু সম্পর্কে জানতে পেরেছি।
উপজেলার নারীনেত্রী কুলসুম বেগম ও মনোয়ারা বেগম বলেন, জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাজে আমরা পরিবেশ নিয়ে অনেক জানতে পারছি। আমরাও এখন থেকে তার দেওয়া ফটোকপি মানুষের কাছে বিতরণ করব, মানুষকে পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করব।
তার এ লড়াই সম্পর্কে স্থানীয় রওশন আরা জলিল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রেজাউল আজাদ, উপজেলা সুজনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মো. মিজানুর রহমান ও উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ডা. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর সংসারের চিন্তা না করে জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন। তার এ উদ্যোগ ছোট হলেও আমরা বুঝতে পেরেছি কাজটি অনেক বড়।
এ ব্যাপারে আশুগঞ্জের ইউএনও মো. নাজিমুল হায়দার বলেন, আমরা পত্রিকায় জলবায়ুবিষয়ক প্রতিবেদন পড়লেও তা অতোটা খেয়াল করি না। তবে এভাবে ফটোকপি পেলে আরেকবার বিশেষভাবে পড়া হবে। মানুষ এতে জলবায়ু ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হবে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
মন্তব্য করুন