‘পানি খেয়ে বমি করলেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে, চিন্তার কিছু নেই।’ এমন আশ্বাস দিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে রাজৈর উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর কাছে যাননি কোন চিকিৎসক। বরং রোগী না দেখে নিজ টেবিলে বসেই ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক শিউলী রানী দাস। 

এভাবে ১৪ ঘণ্টা পার হওয়ার পর অবস্থা খারাপ হলে রোগীর কাছে তড়িঘড়ি গিয়ে হাজির হন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মিঠুন বিশ্বাস। এসময় আগের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ২টি ইনজেকশন পুশ করার পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ইয়াসমিন (১৪) নামে নবম শ্রেণির এক ছাত্রী। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে এই ঘটনা ঘটে। 

ইয়াসমিন রাজৈর উপজেলা সদরের রাজৈর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ও স্থানীয় আলমদস্তার গ্রামের ইলিয়াছ শেখের মেয়ে। এ ঘটনায় রোগীর স্বজনরা তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ প্রদর্শন ও হাসপাতালের আসবাবপত্র ভাঙচুর ও কর্মরত চিকিৎসকদের ঘেরাও করে রাখে। পরে খবর পেয়ে রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহানা নাসরিন ও রাজৈর খানার ওসি খোন্দকার শওকত জাহান ঘটনাস্থলে এসে বিচারের আশ্বাস দিলে রোগীর স্বজন ও স্থানীয়রা ঘেরাও তুলে নেয়। 

রোগীর স্বজন ও স্থানীয়রা জানায়, ইয়াসমিন বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজৈর বাজার থেকে বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ পর মাকে জানায় সে ১০টি ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের রোকজন তাকে রাজৈর হাসপাতালে নিয়ে আসে। এ সময় জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসার শিউলি দাস তাকে কয়েটি স্যালাইন ও ট্যাবলেট লিখে ভর্তি করে নেন। নার্সরা স্যালাইন পুশ করে আর কোন খবর নেননি। এমনকি যিনি রোগী ভর্তি করেছেন সেই শিউলি দাসও আর রোগীর কোন খবর নেননি। রাতে ইয়াসমীন অসুস্থ হলেও কোন নার্স বা ডাক্তারকে পওয়া যায়নি। সকালে ১০টার দিকে ফের অসুস্থ হলে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মিঠুন বিশ্বাস আসেন। পরে দু’টি ইনজেকশন পুশ করার ১০ মিনিটের মধ্যে খিঁচুনি দিয়ে ইয়াসমিন মারা যায়।

ইয়াসমিনের মা লিপি বেগম অভিযোগ করে বলেন, আমার মেয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টার রাজৈর উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করি। এ সময় পেট ওয়াশ না করেই চিকিৎসক বলেন, ‘পানি খেয়ে বমি করলেই ঠিক হয়ে যাবে।’ এরপর একটি ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। তারপর বারবার ডেকেও কোন চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি।  এ অবস্থায় ১৪ ঘণ্টা পার হওয়ার পর  শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে আমার মেয়ের অবস্থার অবনতি হলে ডা. মিঠুন রায় আসেন। এরপর পরপর ২টি ইনজেকশন  (কটসন)  পুশ করেন। এরপরই খিঁচুনি দিয়ে আমার মেয়েটি নিরব হয়ে যায়। অথচ আজ সকাল পর্যন্ত মেয়েটি আমার সঙ্গে ভালভাবে কথা বলেছিল। 

ইয়াসমিনের বাবা ইলিয়াছ শেখ অভিযোগ করে বলেন, আমার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য সব ডাক্তারের কাছে গেছি, কেউ আসেননি। সারারাত কোন নার্স-ডাক্তার আমার মেয়ের কাছে আসেনি। আমার মেয়ে সকালে বলে আমি ভালো হয়ে গেছি বাবা, আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও। আমার সেই ভালো মেয়েকে মিঠুন ডাক্তার ইনজেকশন দেওয়ার পর সে মারা যায়। আমি ডাক্তারদের বিচার চাই। 

মেয়ের মামা শান্টু মিয়া বলেন, ডাক্তার আমার ভাগ্নিকে না দেখেই ভর্তি করেন। ডাক্তারের অবহেলাতেই আমার ভাগ্নির মৃত্যু হয়েছে।

মাদারীপুরের সিভিল সার্জন ডা. শফিকুল ইসলাম জানান, কোনো চিকিৎসকের অবহেলায় যদি রোগী মারা যায় তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রদীপ চন্দ্র মন্ডল জানান, অবহেলা করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে রাজৈর থানার ওসি খোন্দকার শওকত জাহান বলেন, এ বিষয়ে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মাদারীপুর সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।