- সারাদেশ
- অভুক্ত খুলনার ৮ হাজার পরিবহন শ্রমিক
প্রতি মাসে অর্ধকোটিরও বেশি আয় মালিক সমিতির
অভুক্ত খুলনার ৮ হাজার পরিবহন শ্রমিক

খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল এলাকায় সুনসান নীরবতা। মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় টার্মিনাল এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, চার রাস্তার সংযোগস্থলে টেবিল পেতে মাস্ক নিয়ে বসে আছেন হারুন অর রশিদ নামের একজন পরিবহন শ্রমিক। টার্মিনালের শামীম এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠানে টিকিট মাস্টার হিসেবে কাজ করতেন তিনি।
হারুন অর রশীদ বললেন, বাসের টিকিট বিক্রির ওপর আমাদের ইনকাম (আয়)। গত ছয় দিন ধরে বাস বন্ধ, আমাদের ইনকামও বন্ধ। বাস বন্ধ থাকলেও পেট তো বন্ধ নেই। তাই তিন দিন ধরে মাস্ক বিক্রির চেষ্টা করছি। কিন্তু রাস্তায় লোকই নেই। বিক্রিও নেই। কীভাবে যে দিন পার করছি, তা শুধু আমরা জানি।
তার পাশেই বসে ছিলেন রাজু চৌধুরী নামের আরেক শ্রমিক। খুলনা-যশোর রুটের পরিবহনের হেলপার তিনি। রাজু বললেন, ভোর থেকে রাত বাস চালিয়ে ৫০০-৬০০ টাকা পাই। দিনের আয় দিনেই চলে যায়। কিন্তু ছয় দিন ধরে বাস বন্ধ, আয়ও বন্ধ। ঘরে চাল-ডাল প্রায় শেষ। সামনের কয়েকটা দিন যে কীভাবে কাটবে তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছি।
শুধু হারুন অর রশীদ বা রাজু চৌধুরীই নয়, আগামী দিনগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় খুলনার আট হাজার পরিবহন শ্রমিক। গত ছয় দিন সব ধরনের পরিবহন চলাচল বন্ধ। তাদের আয়ের পথও বন্ধ। এমন দুর্দিনে তাদের পাশে নেই মালিকপক্ষ। সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে বাস মালিকদের চারটি সংগঠন থাকলেও তাদের কেউই শ্রমিকদের কোনো খোঁজ নেয়নি। অথচ এই টার্মিনাল থেকে প্রতি মাসে অর্ধকোটি টাকারও বেশি চাঁদা আদায় করেন মালিক সমিতির নেতারা।
টার্মিনাল এলাকা ঘুরে ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনার আন্তঃজেলার ১৮টি রুটে সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল প্রতিদিন ৩০০-৪০০ বাস চলাচল করে। প্রতিটি বাসে চালক, হেলপার, সুপারভাইজারসহ তিনজন কাজ করেন। দুই গেটের বাসগুলোতে কাজ করেন চারজন শ্রমিক। এ ছাড়া টিকিট মাস্টার, কাউন্টার মাস্টার, টার্মিনাল লাইনম্যান, কলারম্যান-স্ট্যাটারসহ আরও বিভিন্ন পদে শ্রমিকরা কাজ করেন। খুলনা মহানগরী ও বিভিন্ন উপজেলা মিলিয়ে মোট শ্রমিক রয়েছেন প্রায় আট হাজার। এর মধ্যে সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে প্রতিদিন কাজ করেন চার হাজার শ্রমিক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে মালিকদের মোট চারটি সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে খুলনা জেলা বাস-মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির আওতায় আন্তঃজেলা ও পার্শ্ববর্তী উপজেলায় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২২০ গাড়ি চলাচল করত। আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতি এবং খুলনার মোটর বাস মালিক সমিতির আওতায় যশোর-কুষ্টিয়া রুটে সরাসরি ও লোকাল মিলিয়ে প্রায় ১৫০-১৮০টি বাস চলাচল করে। রূপসা-গোপালগঞ্জ বাস মালিক সমিতির আওতায় চলে আরও প্রায় ১২০টি গাড়ি।
সূত্রটি জানায়, প্রতিটি গাড়ি থেকে প্রতিদিন মালিক সমিতি আদায় করে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি আদায় করা হয়। এ ছাড়া যশোর-কুষ্টিয়া রুটের গাড়িগুলো থেকে মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নামেও টাকা আদায় করা হয়। এই টাকা লেনদেনের বিষয়টি বাস টার্মিনাল, খুলনার রাজনৈতিক নেতারা, বাস মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে ওপেন সিক্রিট।
শ্রমিকরা জানান, তাদের জন্য এই সেক্টর টিকে থাকলেও বিপদে কোনো সময়ই শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায় না কেউই। দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন সময় শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে মালিকদের খুঁজে পাওয়া যায় না।
এ ব্যাপারে খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কাজী নুরুল ইসলাম বেবী সমকালকে বলেন, ছয় দিন বাস বন্ধ থাকায় আট হাজার শ্রমিকের আয় বন্ধ। আরও কত দিন বাস বন্ধ থাকবে জানি না। এই মানুষগুলোর সংসার কীভাবে চলবে, তা নিয়ে মালিকপক্ষসহ কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। বিভিন্ন জায়গায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সাহায্য-সহযোগিতা করা হলেও পরিবহন শ্রমিকদের জন্য কিছুই করা হয়নি। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমরা ভিন দেশের নাগরিক।
গত ১১ বছর ধরে খুলনা জেলা বাস-মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিজান। তবে গত ডিসেম্বর মাস থেকে তিনি সমিতির বিষয়ে নিষ্ক্রিয়।
সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সোনা বলেন, শ্রমিকদের বিষয়টি শ্রমিক ইউনিয়ন দেখবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।
খুলনা আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতি এবং খুলনার মোটর বাস মালিক সমিতি সভাপতি সাবেক সাংসদ আবদুল গফফার বিশ্বাস। মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়কও তিনি। সমকালকে আবদুল গফফার বিশ্বাস বলেন, এখনও কেউ এ বিষয়ে আমাকে কিছু বলেনি। কেউ বললে ভেবে দেখব।
মন্তব্য করুন