নারায়ণগঞ্জ শহরের শহীদ বাপ্পী সরণির স্থায়ী বাসিন্দা আকতার-উজ-জামান রাসেল। বয়স ৩৫। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) চাকরি করেন। এপ্রিলের শুরুতে তার জ্বর হয়। একপর্যায়ে শুরু হয় কাশি ও শ্বাসকষ্ট। খবর দেওয়া হলে তার নমুনা সংগ্রহ করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। নমুনা সংগ্রহের পর তিন দিন কেটে যায়। আইইডিসিআর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে পুরো পরিবারে। গতকাল রোববার পর্যন্ত রাসেলসহ পরিবারের তিনজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে।

ওই পরিবারের এক সদস্য সমকালের কাছে অভিযোগ করেন, বারবার যোগাযোগ করার পর আইইডিসিআরের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা রাসেলের করোনা 'নেগেটিভ' ইঙ্গিত দিয়ে তাকে সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি ঘরে থাকার পরামর্শ দেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত শুক্রবার (১০ এপ্রিল) নারায়ণগঞ্জে করোনা আক্রান্তদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হিসেবে নির্ধারিত সাজেদা জেনারেল হাসপাতালে চলে যান রাসেল। সেখানে ফের পরীক্ষা করা হলে সেদিন রাতেই জানা যায়, রাসেল করোনায় আক্রান্ত। এ খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তার পরিবারে।

জানা গেছে, আইইডিসিআরের তরফ থেকে পরীক্ষার ফল জানার অপেক্ষায় থাকার এই সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন পরিবারের অন্য সদস্যরাও। তাদের মধ্যে রাসেলের বাবা আফসার উদ্দিন (৫৭) আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। তার দুটি কিডনি বিকল। রোববার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে পরীক্ষায় তার করোনা শনাক্ত হয়। একই সঙ্গে রাসেলের আরেক বোন  ঝর্ণা আক্তারেরও (৩২) করোনা শনাক্ত হয়। তারা এক বাসায় থাকেন। করোনার উপসর্গ নিয়ে বাসায় পড়ে আছেন রাসেলের মা, স্ত্রী এবং আরেক বোনও। রাসেলের এক বছর বয়সী মেয়ে এবং  ঝর্ণা আক্তারের দুই বছর বয়সী ছেলেকে নিয়েও দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা।

পরিবারের তিন সদস্যের করোনা শনাক্তের তথ্য নিশ্চিত করেছেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, ওই পরিবারের অন্য সদস্যদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অবস্থা আরও জটিল হলে তাদের হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে।

রাসেলের ভাগ্নে মারুফ হোসেন বলেন, ৭ এপ্রিল সকালে আইইডিসিআর থেকে লোকজন এসে রাসেলের রক্তের নমুনা নিয়ে যান। পরদিন থেকে তাদের কাছে বারবার ফোন করা হলেও সঠিক পরামর্শ দেননি। একজন অন্যজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এভাবে একে একে নয়জনের সঙ্গে আলাপ করেছি। তাতেও কাজ হয়নি। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন, 'তিন দিনেও যেহেতু কিছু জানানো হয়নি, তাহলে ধরে নিন রোগীর ফল নেগেটিভ।' তিনি রোগীকে সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি ঘরে থাকার পরামর্শ দেন।

মারুফ জানান, কিডনি বিকল হওয়ায় রাসেলের বাবা প্রতি সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করে থাকেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (৯ এপ্রিল) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ডায়ালাইসিস করেন আফসার। একপর্যায়ে তারও জ্বর-সর্দি শুরু হয়। শুক্রবার রাতে রাসেলের করোনা শনাক্ত হওয়ার খবর শুনে শনিবার তারা বাবা-মেয়ে হাসপাতালে যান।

তিনি আরও জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাসেলের বৃদ্ধ বাবার অবস্থা খুবই খারাপ। রাসেলেরও শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি। রাসেল অসুস্থ হওয়ার আগে তার বাবা ছাড়া বাকি সবাই সুস্থ ছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহে প্রায় সবারই জ্বর-সর্দি শুরু হয়। রাসেলের মা কয়েকবার বমিও করেছেন। এমনকি রাসেলসহ পরিবারের তিনজনের মধ্যে করোনা শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানালেও পরিবারের অন্য সদস্যদের নমুনা সংগ্রহে সাড়া পাননি তারা।

তিনি বলেন, করোনার লক্ষণ দেখা দেওয়ার পরপরই মামা বাসায় আলাদা কক্ষে থাকতে শুরু করেন। তার খাবার দরজার সামনে রাখা হতো। সর্বোচ্চ সতর্কতার পরও অন্যদের ঝুঁকিমুক্ত রাখা সম্ভব হয়নি। আইইডিসিআরের গাফিলতির কারণে ভাইরাসের সংক্রমণ পুরো পরিবারে ছড়িয়ে পড়েছে। শুরুতেই মামাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে অন্যদের এ অবস্থা হতো না।