অর্ণব বিশ্বাসকে অটিজমের সংজ্ঞায় বলা হয় অতিমাত্রায় আক্রান্ত। আছে ডায়াবেটিস, খিঁচুনি। মুখে তেমন বলতে পারে না; ঠিকমতো করতে পারে না নিজের দৈনন্দিন কাজও। আগে প্রতিদিন সকালের নাস্তা খেয়ে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিত। অপেক্ষায় থাকত গাড়ির জন্য। ঘর থেকে বাইরে গিয়ে প্রশান্তি খুঁজে পেত অনেকটা। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এখন দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ স্কুল। হয়তো আরও দীর্ঘায়িত হবে প্রাতিষ্ঠানিক এই ছুটি। দিনের অনেকটা সময় আগে বাইরে থাকা হলেও এখন ২৪ ঘণ্টাই ঘরবন্দি। অঘোষিত লকডাউনে যেখানে স্বাভাবিক মানুষের ঘরে থাকা কঠিন; সেখানে অর্ণবদের ঘরে থাকা অনেক কষ্টের। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাদের সময়। করোনার এমন পরিস্থিতিতে তাই ভালো নেই হাজারো অর্ণব। তাদের মতোই অটিজম সদস্যের পরিবারের জন্যও অনেক কঠিন প্রতিটি দিন। ঘরবন্দি জীবনে সন্তানদের ভালো রাখতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে হাজারো পরিবারকে। অটিজম আক্রান্তদের অন্যতম সমস্যা সামাজিক যোগাযোগ। এর সঙ্গে থাকে অস্থিরতা, আচরণগত সমস্যা এবং একই কাজ বারবার করার প্রবণতা। রুটিন মাফিক চলতে চায় তারা।

এর ব্যতিক্রম হলে বেড়ে যায় তাদের অস্থিরতা। স্কুলের রুটিন মাফিক চর্চা না হলে অর্জিত দক্ষতা ও জ্ঞান কমে যেতে পারে তাদের। তাই এ দীর্ঘ ছুটিতে এদের পরিবারের বাড়তি চিন্তা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এ সদস্যকে নিয়ে। করোনার এমন সময়ে অটিজমদের ভালো রাখতে ও তাদের সময়গুলো ভালোভাবে পার করতে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ সংশ্নিষ্টরা। তারা দেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী অটিজম আক্রান্ত শিশুর হার আগের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়ে বর্তমানে প্রতি ৫৪ জনে একজন অটিজম আক্রান্ত। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অটিজম হয় ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি। সমাজসেবার তথ্যমতে, দেশে মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৯৯ হাজার ৯৩ জন। এর মধ্যে অটিজম ব্যক্তির সংখ্যা হচ্ছে ৪৬ হাজার ৩৭২ জন। যার মধ্যে চট্টগ্রামেই রয়েছে এক-চতুর্থাংশ।

চট্টগ্রামে ২০১০ সাল থেকে অটিজমদের নিয়ে কাজ করা নিষ্পাপ অটিজমের সেক্রেটারি ইঞ্জিনিয়ার ঝুলন কুমার দাশ মোবাইল ফোনে সমকালকে বলেন, 'করোনার এই সময়ে ঘরেবন্দি প্রতিটি স্বাভাবিক মানুষের যেখানে মানসিক প্রশান্তি ও ভারসাম্য রেখে চলা কষ্টকর; সেখানে অটিজম শিশু, ব্যক্তি, পরিবারের কী অবস্থা একবার ভেবে দেখুন! এমন দুঃসময়ে অটিজমদের সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখছি। কারও কোনো শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক তার ব্যবস্থা নিচ্ছি।

পরিবারকেও নানা পরামর্শ দিচ্ছি।' চট্টগ্রামের প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বাসনা মুহুরী একজন অটিজম শিশুর মা। অর্ণবের মা তিনি। পাশাপাশি তিনি একজন অটিজম সংগঠকও। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাকে ঘরবন্দি জীবনে ভালো রাখতে রাত-দিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক। অধ্যাপক ডা. বাসনা মুহুরী সমকালকে বলেন, 'অর্ণব পড়ে সুইট বাংলাদেশ নামক একটি স্কুলে। ২০০৭ সালে তার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। আছে খিঁচুনিও। স্বাভাবিক মানুষের মতো নয় ওর চারপাশ। তার দৈনন্দিন কাজও আমাদের মতো নয়। ওর প্রতিদিনের পছন্দের রুটিন সকাল হলেই ব্রেকফাস্ট করে স্কুলের জন্য তৈরি হওয়া। স্কুল তার খুব পছন্দের জায়গা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও ওকে ঘরে রাখতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু অনেক দিন হলো ওর স্কুল বন্ধ। তবে স্কুল বন্ধ থাকলেও বেশ কিছু দিন ব্রেকফাস্ট করে স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে যেত সে। অপেক্ষায় থাকত গাড়ির জন্যও। বুঝানোর চেষ্টা করতাম। অনেক সময় বুঝত, অনেক সময় আবার বুঝতে চায় না সে। তবে আস্তে আস্তে তাকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। চিৎকার-চেঁচামেচি করলে ওর এ আচরণকে না দেখার ও শোনার ভান করি। পছন্দের জিনিস দিয়ে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি তাকে। তবে আগের তুলনায় অনেক অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে।' ১৫ বছরের অটিজম মেয়ের এক মা বলেন, 'ওকে ঘরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাতে কিছুটা ভালো থাকলেও দিনের বেশিরভাগ সময় তার মেজাজ থাকে খিটখিটে। বাইরে চলে যেতে চায়। বেশ কিছুদিন ঘরে থাকার কারণে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। আগের দৈনন্দিন কাজগুলোতে ফিরে যেতে চায় বেশি।'

অটিজম পরিবারের জন্য পরামর্শ  : চিকিৎসক ও অটিজম বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো- ঘরে থাকার এই সময়ে একটি দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করুন তার পছন্দমতো। পরিবারের সবার সঙ্গে সব কাজে সম্পৃক্ত করুন ওকে। ওকে নিয়ে একসঙ্গে টেলিভিশন দেখুন। খেলুন, গান শুনুন, গল্প করুন, কথা বলুন। কোনোভাবে ধৈর্য হারানো যাবে না। ওদের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করুন ও কাজে লাগান সেটিকে।