চট্টগ্রামে হুহু করে করোনা রোগী বাড়লেও বাড়ানো যাচ্ছে না হাসপাতালের সংখ্যা। দুই মাস চেষ্টার পরেও ৯০টি বেসরকারি হাসপাতালের কোনোটিই মেলেনি করোনা রোগীর জন্য। এসব হাসপাতালে চার হাজার ১৫৭টি বেড থাকলেও ব্যবসা হারানোর ভয়ে তার একটিও দিতে রাজি হননি ওইসব হাসপাতাল মালিকরা। বিকল্প হিসেবে পরিত্যক্ত একটি হাসপাতালকে সংস্কার করে দেন তারা। কিন্তু এই হাসপাতালের পরিচালনা নিয়ে আবার দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ায় করোনা রোগীর চিকিৎসা শুরু করা যায়নি সেটিতেও। অথচ দুই কোটি মানুষের করোনা চিকিৎসায় এখন সরকারি মাত্র দুটি হাসপাতাল ব্যবহূত হওয়ায় সেগুলোতে প্রায় ঠাঁই নেই অবস্থা। কারণ, চট্টগ্রামে এখন প্রতিদিন শতকের কাছাকাছি হচ্ছে নতুন রোগীর সংখ্যা।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির সমকালকে বলেন, 'আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সুবিধা থাকা ১২টি বেসরকারি হাসপাতালকে বাছাই করা হলেও নানা কারণে সেগুলো পাওয়া যায়নি। বিকল্প হিসেবে হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে প্রস্তুত করে দেন বেসরকারি মালিকরা। কিন্তু এটি পরিচালনা করতে গেলে ডাক্তার, নার্সদের বেতন ও মেইনটেন্যান্স বাবদ কোটি টাকা খরচ হবে প্রতি মাসে। তাই এটি চমেক হাসপাতালের অধীনে নিয়ে কারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার কথা বলছেন তারা। আমরা সিদ্ধান্ত চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত রোগী ভর্তি করতে পারব না ওখানে। তবে রোগী যে হারে বাড়ছে, তাতে নতুন একটি হাসপাতাল খুব জরুরি হয়ে পড়েছে আমাদের জন্য।'
জানা গেছে, নগরে ৯০টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ১৮৩টি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি (ডায়াগনস্টিক সেন্টার) আছে। এসব হাসপাতালে অনুমোদিত শয্যা আছে চার হাজার ১৫৭টি। এর মধ্যে শত শয্যার বেসরকারি হাসপাতাল আছে একডজনেরও বেশি। পার্কভিউ, ন্যাশনাল, ম্যাক্স, মেট্রোপলিটন, মেডিকেল সেন্টার ও সার্জিস্কোপ এর মধ্যে অন্যতম। আবার রয়েল, সিএসসিআর, ডেল্টাসহ দেড়ডজন হাসপাতালের প্রতিটিতে শয্যা আছে পঞ্চাশেরও বেশি। এসব হাসপাতালের সঙ্গে আছে প্যাথলজিক্যাল ল্যাব। আছে আইসিইউ। আছে ভেন্টিলেশন সুবিধাও। কাগজে কলমে ৩১টি আইসিইউ থাকলেও এইচডিইউসহ অন্যান্য বিশেষায়িত ইউনিট যুক্ত করে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা যাবে আরও দ্বিগুণসংখ্যক রোগী। কিন্তু কোনো বেসরকারি হাসপাতালই করোনা রোগীদের দিতে চাচ্ছে না সেবা। পার্কভিউ হাসপাতাল শুরুতে ১৪টি আইসিইউর মধ্যে প্রাথমিকভাবে চারটি আইসিইউ দেবে বলে সম্মত হলেও পরে সরে আসে সেটি থেকেও।
ট্রাস্টির মাধ্যমে পরিচালিত বেসরকারি হাসপাতালও সাড়া দিচ্ছে না প্রশাসনের ডাকে। সর্বোচ্চ আইসিইউ সুবিধা থাকা অত্যাধুনিক ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আগ্রহ দেখাচ্ছে না করোনা রোগীর জন্য। ডায়াবেটিক হাসপাতালে আছে ১৫০ শয্যা। মা ও শিশু হাসপাতালে আছে ৫০০ শয্যা। ইউএসটিসির হাসপাতালে আছে ৩০০ শয্যা। কিন্তু তারাও করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতে রাজি হচ্ছে না।
জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) গঠিত কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক ডা. আ ন ম মিনহাজুর রহমান বলেন, 'প্রায় ৯০টি বেসরকারি হাসপাতাল থাকার পরও কেন পরিত্যক্ত হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালকে করোনা রোগীর জন্য সংস্কার করা হলো! মা ও শিশু হাসপাতাল, ইউএসটিসি, সাউদার্ন মেডিকেল, ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও পার্কভিউ হাসপাতালে ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ পর্যন্ত শয্যা আছে। এসব হাসপাতাল থেকে রোগীরা সেবাও বেশি পেতেন। কিন্তু হলিক্রিসেন্টে এখন সেবা পাবেন মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ জন। মূলত ব্যবসা কমে যাওয়ার ভয়েই বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা করোনা রোগের জন্য এসব হাসপাতাল দিতে চাচ্ছেন না।' একই কারণে বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা আগে চূড়ান্ত হওয়া ১২টি হাসপাতাল দেননি বলে মন্তব্য করেন তিনি। বেসরকারি হাসপাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী বলেন, '১২টি হাসপাতাল অন্য রোগীর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দরকার হলে পরবর্তীতে করোনার জন্য এখান থেকেও হাসপাতাল দেব আমরা। তবে বিকল্প হিসেবে আমরা প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল সংস্কার করে দিয়েছি। এখন এটি চালু করা সরকারের দায়িত্ব।'
এমন ঠেলাঠেলির কারণে গত দুই মাসেও বিকল্প কোনো হাসপাতাল তৈরি হয়নি চট্টগ্রামে। দুই কোটি মানুষের জন্য চট্টগ্রামে এখন করোনা রোগীর চিকিৎসায় আছে কেবল সরকারি জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডি হাসপাতাল। এ জন্য অনেক রোগীকে এখন বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে বলছেন ডাক্তাররা। এতে করে সংক্রমণ বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুহারও।