'একেবারে ছোট ছেলেটার বয়স মাত্র এক মাস। পৃথিবীতে এসেছে সে করোনার এই দুঃসময়ে। বাসায় কেউ নেই। চার সন্তান নিয়ে একা স্ত্রী। আম্পানের বিপদসংকেত যখন বাড়ছিল, তখনও আমি জাহাজে- তবে নোঙর করেছিলাম জেটিতে। কিন্তু মহাবিপদ সংকেত উঠতেই ছুটতে হলো জাহাজ নিয়ে। জেটি ছেড়ে চলে যেতে হলো কুতুদিয়ার গভীর সমুদ্রে। স্ত্রী খুব মন খারাপ করছিল। কাঁদছিল সন্তানরাও। কিন্তু আবেগের চেয়ে দায়িত্ব বড়। তাই সবকিছু তুচ্ছ করে জাহাজকে নিরাপদে নোঙর করতে চলে যাই গভীর সমুদ্রে। বারবার পরিবারের কথা মনে হলেও কিছুই করার থাকে না।'

ঘূর্ণিঝড়ের মহাবিপদ সংকেতে তীর ছেড়ে গভীর সমুদ্রে চলে যাওয়ার দুঃসহ স্মৃতি এভাবেই বলছিলেন বাংলার জ্যোতি জাহাজের ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম হোসাইন। শুধু মোয়াজ্জেম নন- চট্টগ্রাম বন্দরসীমায় থাকা ১৬০ জাহাজের প্রতিটিকেই তখন মহাবিপদ সংকেতে তীর ছেড়ে যেতে হয় গভীর সাগরে। মহাবিপদে সবাই যখন ঘরে ফিরে আসেন, তারা তখন নীড় ছেড়ে পা বাড়ান অনিশ্চিত সমুদ্রে।

কেন জেটিতে থাকা জাহাজকে মহাবিপদে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে গভীর সমুদ্রে যেতে হয়?- এ প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-সংরক্ষক ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম বলেন, ' প্রচণ্ড ঝড়ে রশি ছিঁড়ে জেটিতে বাঁধা বড় জাহাজগুলো একটি আরেকটির ওপর আছড়ে পড়তে পারে। আবার বন্দর চ্যানেলে যদি কোনো শিপ ডুবে যায়, তবে বন্দরে জাহাজ আসা-যাওয়া বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। ঝুঁকি এড়াতে মেরিটাইম ওয়ার্ল্ডে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরেও (এসওপি) বড় জাহাজকে ঘূর্ণিঝড়ের সময় গভীর সাগরে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলা আছে।'

বিদেশি জাহাজ এলেও বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আনা-নেওয়ার কাজ করেন ১৪ জন পাইলট। বন্দর থেকে জাহাজ বের করার দায়িত্বও পালন করেন তারা। মহাবিপদ সংকেতেও এ কাজটি করতে হয় তাদের। বন্দর চ্যানেলের মোহনা থেকে প্রায় দুই নটিক্যাল মাইল দূর পর্যন্ত তারা জাহাজ চালিয়ে নেন। এরপর জাহাজের নিজস্ব ক্যাপ্টেন এটির নিয়ন্ত্রণ নেন।

চট্টগ্রাম বন্দরের সিনিয়র পাইলট মোস্তাহিদুল ইসলাম বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়ের সময় বড় জাহাজ সাগরেই নিরাপদ। সুপার সাইক্লোন হলেও সাগরে জাহাজ ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারে। ঢেউ চলে যাওয়ার পর পানিতে জাহাজ আছড়ে পড়বে। কিন্তু ডুবে যাবে না। প্রচণ্ড বাতাসে কোনাকুনিভাবে জাহাজকে আস্তে আস্তে একটি নির্ধারিত সীমায় চালাতে হয়। বড় জাহাজগুলোতে দুটি ইঞ্জিনই এ সময় চালু রাখতে হয়।' মহাবিপদ সংকেতে জাহাজ নিয়ে চ্যানেল অতিক্রম করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'একবার জাহাজে ওঠানামা করার মই ছিঁড়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল সাগরে। এটা ভয়াবহ ঝুঁকির কাজ। তারপরও এটা করতে হচ্ছে।'

বাংলার জ্যোতি জাহাজের ক্যাপ্টেন জানান, তার জাহাজে ৪০ জন নাবিক-ক্রুর সবাই মহাবিপদ সংকেতে ছিলেন গভীর সাগরে। আম্পান ছাড়াও তিনি ঘূর্ণিঝড় ফণী, রোয়ানু ও বুলবুলের সময় জাহাজ নিয়ে গেছেন গভীর সমুদ্রে। ক্যাপ্টেন জানান, গভীর সমুদ্রে এ সময় একটি জাহাজ আরেকটি জাহাজ থেকে অন্তত ৩ থেকে ৪ মাইল দূরে অবস্থান নেয়। দু-তিন মাসের খাবার নিয়ে তারা জাহাজে থাকেন। যাতে বড় ধরনের কোনো বিপদে সামলে নেওয়া যায়।