বন্দরনগরী চট্টগ্রামে করোনভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় জট লেগেছে। ১৫ থেকে ২০ দিন পরও মিলছে না নমুনা পরীক্ষার ফল। অথচ সংক্রমণ প্রতিরোধে বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষা ও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল দেওয়ার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চট্টগ্রামে পরীক্ষা ছাড়াই প্রতিদিন পড়ে থাকছে ৬০০ থেকে ৮০০ নমুনা। বর্তমানে বেশ কয়েকদিন আগে সংগ্রহ করা প্রায় পাঁচ হাজার নমুনা পড়ে আছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ল্যাবে। অগত্যা করোনা পজিটিভ রোগীদের দ্বিতীয় পরীক্ষাও বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। অনেক নমুনা আবার হারিয়েও যাচ্ছে। এভাবে কভিড-১৯-এ দেশের দ্বিতীয় ভয়ংকর হটস্পট চট্টগ্রামে নমুনা পরীক্ষা নিয়ে চলছে একপ্রকার তামাশা। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেরিতে নমুনা পরীক্ষা হলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
জট কমাতে গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম থেকে তিন হাজার নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। এসব নমুনার বেশকিছু হারিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে কয়েক দফায় আরও কয়েক হাজার নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়। তবে এতকিছু করেও নমুনা জট কমাতে ব্যর্থ হচ্ছে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য প্রশাসন।
চট্টগ্রামের দুই কোটি মানুষের জন্য ল্যাব চালু আছে মাত্র চারটি। নিয়ম অনুযায়ী পজিটিভ হওয়া রোগীদের ১৪ দিন পর দু'দফায় নমুনা পরীক্ষা করার কথা। এখানে তাও মানা হচ্ছে না। প্রথম পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়ার পর বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়ে দিনের পর দিন ঝুঁকি নিয়ে এক ল্যাব থেকে ঘুরে অন্য ল্যাবে গিয়েও নমুনা পরীক্ষা করাতে পারছেন না আক্রান্ত অনেক রোগী। এ অবস্থায় শরীরে কোনো উপসর্গ না থাকার পরও দ্বিতীয় পরীক্ষা করাতে না পেরে অনেকে ফিরে যেতে পারছেন না স্বাভাবিক জীবনে। অনেকে আবার বহু কষ্টে দ্বিতীয় দফায় নমুনা দিতে পারলেও দুই সপ্তাহ পরও পাচ্ছেন না ফল। এ কারণে যোগ দিতে পারছেন না কর্মস্থলেও।
এমন ভয়াবহ জটের কারণে ল্যাবপ্রধানরা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি আর সমন্বয়ের অভাবকে দুষছেন। নমুনা পরীক্ষার তীব্র জটের কথা স্বীকার করে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি সমকালকে বলেন, 'চট্টগ্রাম নগরের পাশাপাশি উপজেলায়ও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এখন প্রচুর মানুষ করোনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহী হচ্ছেন। লকডাউন স্বাভাবিক করার পর নেগেটিভ রিপোর্ট ছাড়া অফিসে ঢুকতে না দেওয়ার নিয়মও করেছে অনেকে। এসব কারণে প্রতিদিন প্রচুর নমুনা সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তবে যে হারে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে সে তুলনায় পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য আমাদের নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতা আছে। প্রতিদিনই অনেক নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই থেকে যাচ্ছে।'
তিনি জানান, নমুনা জট কমাতে করোনা পজিটিভ হওয়া রোগীদের দ্বিতীয়বারের পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। তিন দিন জ্বর ও শ্বাসকষ্ট না থাকলে তারা ধরে নিচ্ছেন যে তিনি সুস্থতার পথে। দ্বিতীয়বারের করোনা পরীক্ষার চেয়ে আইসোলেশনে থাকাকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে কয়েকটি নতুন ল্যাব চালুর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে।
করোনা মোকাবিলায় স্বাচিপ গঠিত কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়ক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান সমকালকে বলেন, 'চট্টগ্রামে নমুনা পরীক্ষা নিয়ে যা চলছে তা তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। নমুনা সংগ্রহের পর দ্রুত পরীক্ষা করা হলে প্রকৃত ফল আসে। কিন্তু বর্তমানে ১৫-১৬ দিন পরও আসছে না নমুনার ফল। এখন তিন ভাগের মাত্র এক ভাগ টেস্ট হচ্ছে। গত ৩১ মে ও ১ জুন জমা দেওয়া নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট এসেছে ২০ জুন। অনেকে রিপোর্ট পাওয়ার আগেই মারা গেছেন। অনেকে আবার সুস্থও হয়ে গেছেন। দেরিতে নমুনা পরীক্ষা হওয়ার কারণে নমুনার কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে পজিটিভ পাওয়া যায় কম। এতে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। পরীক্ষা ছাড়াই বর্তমানে চার থেকে পাঁচ হাজার নমুনা ল্যাবে পড়ে আছে।'
চট্টগ্রামের প্রধান পরীক্ষাগার বিআইটিআইডির ল্যাবপ্রধান অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, 'ল্যাবগুলোতে জনবলের সংকট থাকলেও তা নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসরকারি ল্যাবগুলোকে দ্রুত সম্পৃক্ত করতে হবে।'
গত ৮ জুন চট্টগ্রামের পটিয়ার ইউএনও ফারহানা জাহান উপমার নমুনা জমা দিলেও আজ পর্যন্ত হাতে এসে পৌঁছায়নি রিপোর্ট। তিনি বলেন, 'নিজের পাশাপাশি গাড়িচালক, বাসার মালিসহ পরিবারের ১০ জনের নমুনা জমা দেওয়া হয় ৮ জুন। এ ছাড়া ৭ ও ৮ জুন পটিয়া থানা পুলিশের পাঁচ সদস্যও নমুনা দিয়েছিলেন। কিন্তু কারও নমুনা পরীক্ষার ফল এখনও আসেনি।'
পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ জাবেদ জানান, ৮ জুন সংগ্রহ করা নমুনার রিপোর্টগুলো বিআইটিআইটি ল্যাবে পাঠানো হয়। সেখানে জট থাকায় নমুনাগুলো ঢাকায় পাঠানো হয়।
একটি ওষুধ কোম্পানিতে কেমিস্ট হিসেবে দায়িত্বরত কাজী গোলাম মোস্তফা সমকালকে বলেন, 'অফিসে যোগ দিতে নেগেটিভ রিপোর্ট দেখাতে হবে। তাই অনেক কষ্ট করে ৬ জুন নমুনা জমা দিই। কিন্তু এখনও রিপোর্ট না পাওয়ায় কাজে যোগ দিতে পারিনি।'
গত ৩ জুন চট্টগ্রামে অবস্থান করা এস্ত্রেলা কাতান নামে ফিলিপাইনের এক নাগরিকের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও ১৬ দিনেও মেলেনি করোনা পরীক্ষার ফল। গত ১৮ জুন রাতে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান তিনি। ফিলিপাইন কনস্যুলেট অফিসের চিফ অব স্টাফ শেখ হাবিবুর রহমান বলেন, 'তাদের বলা হয়েছে যে, কিছু নমুনা নাকি হারিয়ে গেছে।'