সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের মতো বড় বড় দুর্যোগে প্রতিবছর সারাদেশের বেড়িবাঁধগুলো বিধ্বস্ত হয়। এজন্য প্রতিবছর বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং সংস্কার বাবদ বাজেটে মোটা অঙ্কের বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে বাঁধ সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারি এ বরাদ্দের বেশিরভাগ অর্থই নয়ছয় হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। যেনতেন কাজ দেখিয়ে পকেট ভারী হচ্ছে প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের।
জরুরি কাজের অজুহাতে (ডিপিএম পদ্ধতি) অতীতে কোটি কোটি টাকার সংস্কার কাজ হয়েছে। তবে ঝড়ে প্রবল পানির চাপে এসব বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। প্রতিবছর এভাবে বাঁধ সংস্কারের নামে দুর্নীতি হলেও এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নজরদারি নেই বলে জানা গেছে। এ কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও সরকারের এ কাজে বরাদ্দ থেমে নেই। উপকূলীয় জেলায় বাঁধ সংস্কারের জন্য শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে সরকার। সম্প্রতি আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় জেলায় বাঁধ সংস্কার ও মেরামতের জন্য আবারও ডিপিএম পদ্ধতিতে কাজ শুরু হচ্ছে। সম্প্রতি একনেকে সাতক্ষীরায় লবণাক্ত পানির প্রবেশ বন্ধে ৪৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাঁধ সংস্কারে যথাযথ তত্ত্বাবধান না হওয়ায় একই স্থানে বার বার বেড়িবাঁধ ভাঙছে। এতে সরকারের বরাদ্দ শত শত কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে।
দুর্নীতির সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা জড়িত থাকলেও তারা সব সময় থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষ বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। এদিকে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণে পাঁচটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প প্রণয়ন করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এসব প্রকল্প পর্যায়ক্রমে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
ইতোমধ্যে সাতক্ষীরায় পানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে জোয়ারের চাপ ও ঝড়ো বাতাসের কারণে লবণাক্ত পানির প্রবেশ বন্ধে ৪৭৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এ প্রকল্পের আওতায় ওই এলাকার ৬০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নদী পুনঃখনন করা হবে। নদী ড্রেজিং করা হবে ২০ দশমিক ৫০ কিলোমটার। খাল পুনঃখনন করা হবে ৩৪৪ কিলোমিটার। বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ করা হবে ১১৩ কিলোমিটার এবং ২৭টি নিস্কাশন রেগুলেটর মেরামত ও পুনর্গঠন করা হবে।
তবে দেশের উপকূলীয় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত নয় বলে জানিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে যে বাঁধগুলো রয়েছে সেগুলো নিয়মিত জোয়ার-ভাটা প্রতিরোধে সক্ষম।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার সমকালকে বলেন, সরকার প্রতিবছর যে বরাদ্দ দেয় সেটা সামগ্রিক ১৭ হাজার কিলোমিটার বাঁধের উন্নয়নের জন্য। প্রতি অর্থবছরের বাজেটে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার বাবদ যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় সেটা প্রয়োজনের দশ ভাগের এক ভাগ। সচিব বলেন, অর্থাৎ সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় বাঁধ থেকে শুরু করে আট হাজার কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নদীতীরবর্তী বাঁধ এবং আড়াই হাজার কিলোমিটার হাওর অঞ্চলের ডুবন্ত বাঁধ সংস্কারে সরকার এই অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
সচিব বলেন, নতুন প্রকল্পগুলো পাস হলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ কাজ শুরু হতে পারে এবং সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে বড় বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, এটা প্রতিবছর চলতেই থাকবে। এজন্য আমরা বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এগুলো ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা হবে। এজন্য সময় লাগবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে উপকূলীয় বাঁধের পরিধি পাঁচ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে অন্তত ৫০০ কিলোমিটারজুড়ে পাঁচ থেকে ছয় মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার, যাতে শক্তিশালী জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধ করা যায়। এজন্য কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণে পাঁচটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলো অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তা বে দেশের সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলাসহ নয়টি জেলার বেড়িবাঁধ ভেঙে কয়েকশ' গ্রাম প্লাবিত হয়। এসব জেলার পাশ দিয়ে যেসব নদী বয়ে গেছে সেগুলোর বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় মুহূর্তেই তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। যখন সরকারি কোনো চুক্তি হয় তখন সেটার বরাদ্দকৃত অর্থ অনেকভাবেই ভাগাভাগি হয়ে যায় বলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।
সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র মতে, দীর্ঘ ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে বেড়িবাঁধগুলো পূর্ণাঙ্গ সংস্কার এবং মেরামত না হওয়ায় দেশের উপকূলীয় ২৫ জেলার লাখ লাখ মানুষ চরম ঝুঁকিতে দিন কাটাচ্ছেন। সম্প্রতি আম্পানের তা বে উপকূলীয় এলাকায়সহ জলোচ্ছ্বাসে সারাদেশে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বাঁধগুলো সংস্কারে মেগা প্রকল্প না নিলে আগামীতে অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১৪-১৫ ফুট উঁচু উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে আশঙ্কা রয়েছে।
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পরে এবারই সবচেয়ে প্রবল শক্তিতে উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। দীর্ঘ সময় ধরে ঝড় বয়ে যাওয়ায় ল ভ হয়ে গেছে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরসহ অন্যান্য উপজেলা। দুমড়েমুচড়ে গেছে কাঁচা ঘর, দোকানপাট ও আধপাকা দালান।