চট্টগ্রামে পাহাড় সাবাড়ে 'সহযোগী'র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সরকারি সাত সংস্থার ৩০ থেকে ৩৫ জনের সিন্ডিকেট। পাহাড়খেকোদের সঙ্গে সখ্য রেখে সরকারি এসব সংস্থার একাধিক সিন্ডিকেট বিনামূল্যে হাতিয়ে নিচ্ছে প্লট। বিনিময়ে পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা অবৈধ বসতিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) করে দিচ্ছে রাস্তা, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দিচ্ছে ভবন তৈরির অনুমোদন। পিডিবি দিচ্ছে বিদ্যুৎ, ওয়াসা দিচ্ছে পানি, কেজিডিসিএল দিচ্ছে গ্যাস।
আবার পাহাড়ি এলাকায় রেলওয়ে কিছু কিছু জায়গা দীর্ঘমেয়াদে লিজ বা ইজারা দিচ্ছে। লিজ নেওয়া প্রতিষ্ঠান এরপর দখলে নিচ্ছে সেই পাহাড়। নানাজনের নানাভাবে গড়ে ওঠা এসব অবৈধ বসতি আবার পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। সর্ষের মধ্যে এমন ভূত থাকায় পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও দীর্ঘস্থায়ী কোনো সুফল পাচ্ছে না প্রশাসন।
করোনাকালে চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা অবৈধ কিছু বসতির নেপথ্যে সম্পৃক্ত রয়েছে নানা ভুঁইফোঁড় সংগঠন। মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, হকার ইত্যাদি পেশাজীবীদের বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে দখল করা হচ্ছে একের পর এক পাহাড়। একসঙ্গে ১০ সংস্থাকে নিয়ে ১৬ পাহাড়ে পরিচালিত এক অভিযানে গত বুধবার এমন ৩৫০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে প্রশাসন। এ সময় জালালাবাদ মৌজার চারটি পাহাড় থেকে ২২টি বিদ্যুতের মিটারও জব্দ করা হয়। আবার জঙ্গল সলিমপুর ও উত্তর পাহাড়তলীর কয়েকটি পাহাড়েও পাওয়া গেছে আটটি মিটার।
পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা কোনো বসতঘরে মিটার থাকার কথা নয়। কারণ মিটার আনতে হলে জমির খতিয়ানসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কাগজপত্র থাকতে হয় আবেদনকারীর। এমন কাগজপত্র না থাকার পরও পিডিবির অবৈধ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশে মিটার বসিয়েছে দখলদাররা। এমন একটি মিটার থেকে পরে আরও অন্তত ১৫ থেকে ২০টি ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ টেনেছে তারা। নগরীর মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ঘেঁষা কয়েকটি বসতঘর থেকে ইতোপূর্বে গ্যাসের চুলাও উদ্ধার করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অথচ সাধারণভাবে গ্যাস সংযোগ পেতেই অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় মানুষকে। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির লোকজনের সঙ্গে সখ্য থাকায় এখানেও অসম্ভবকে সম্ভব করেছে দুর্বৃত্তরা। শুধু তাই নয়; পাহাড়ি এলাকায় একের পর এক ডিপটিউবয়েলও বসাচ্ছে দখলদাররা। উচ্ছেদ অভিযানে গিয়ে একাধিক ডিপটিউবয়েলেরও সন্ধান পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটরা। অথচ সমতল ভূমিতেই এখন এগুলো বসানোর অনুমতি নেই। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপকে নিরুৎসাহিত করছে ওয়াসা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ একেএম ফজলুল্লাহ বলেন,
'নগরীর কোথাও গভীর নলকূপ বসাতে হলে ওয়াসার অনুমতি নিতে হয়। বিভিন্ন কারণে আমরা এটি নিরুৎসাহিত করছি। কীভাবে পাহাড়ে ওয়াসার সংযোগ গেল, কীভাবে গভীর নলকূপ বসানো হলো- এসব আমরা খতিয়ে দেখব। ওয়াসার কেউ দখলদারদের সহযোগী হলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।'
তিতাস গ্যাসে কর্মরত থাকা কেজিডিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, 'আবাসিকে গ্যাস সংযোগ দেওয়া অনেক দিন ধরেই বন্ধ আছে। আগে যারা সংযোগ নিয়েছেন, তাদের অবশ্যই জমি কিংবা ভবনের মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে হয়েছে। পাহাড়ে কোনোভাবেই গ্যাসের বৈধ সংযোগ যাওয়ার কথা নয়। তবে চক্রের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে অনেকে জাল কাগজপত্র তৈরি করে সংযোগ নিতে পারে।'
পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামছুল আলম বলেন, 'পিডিবির মিটার দেওয়ার আগে আমরা জমির খতিয়ান চাই। পাহাড়ের অবৈধ ঘরে কীভাবে বিদ্যুতের মিটার গেল, তা যাচাই করা হবে। পিডিবির কারও যোগসাজশ না থাকলে ওখানে মিটার যাওয়ার কথা নয়। যে মিটারগুলো জব্দ করা হয়েছে সেগুলো পোস্টপেইড থেকে এখন প্রিপেইডে রূপান্তরিত।'
শুধু সহযোগিতা নয়; সরাসরি পাহাড় কাটার অভিযোগও আছে সরকারি অনেক সংস্থার বিরুদ্ধে। চসিক পাহাড় কেটেই নগরীতে পৃথক তিনটি আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে। পাহাড় কেটেই তারা বাস্তবায়ন করে লেকসিটি হাউজিং প্রকল্প, কোবে সিটি হাউজিং প্রকল্প ও ভিআইপি হাউজিং সোসাইটি। এসব প্রকল্পে সহস্রাধিক প্লট রয়েছে তাদের। জালালাবাদ হাউজিং ও নীলাচল হাউজিং সোসাইটিতে পাহাড় কেটে রাস্তাও তৈরি করে দিয়েছে চসিক।
পাহাড় কাটায় পিছিয়ে নেই খোদ ইমারত ও আবাসন প্রকল্প অনুমোদনের দায়িত্বে থাকা সংস্থা সিডিএ। ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের সঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী রোডের সংযোগ ঘটাতে পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই তারা পাহাড় কাটে নির্বিচারে। ১৫টি পাহাড় কাটায় এরই মধ্যে তাদের প্রায় ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পাহাড় কাটার এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই সরকারি আরেক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ওয়াসা। নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় পাহাড় কেটে তারা বাস্তবায়ন করছে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প।
এদিকে পুলিশেরও বেশকিছু সদস্যের যোগসাজশ রয়েছে পাহাড় কাটায়। কাটা পাহাড় পাহারাও দিচ্ছে এরা। বায়েজিদ, পাহাড়তলী ও সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের একটি চক্র পাহারা দেওয়ার বিনিময়ে প্লট হাতিয়ে নিচ্ছে পাহাড় থেকে। শেল্টার দিতে ভুঁইফোঁড় সাংবাদিকদের প্লট দিয়ে সাহায্য নিচ্ছে পাহাড়খেকোরা। অবশ্য সাংবাদিকদের ব্যানারেও দখল করা হচ্ছে পাহাড়। হকার্স লীগের ব্যানারেও পাহাড় কেটে তৈরি হচ্ছে প্লট। একেকজন একেক নামে পাহাড় দখলে তৎপর হলেও সবাই সামনে রাখছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের। এরাই সরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার সুবিধা নিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এই সিন্ডিকেটে ৩০ থেকে ৩৫ জন জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে প্রশাসন। এদের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা।
পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনাকারী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, '১৬ পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে ৩০টি বিদ্যুতের মিটার উদ্ধার করেছি। এর আগে মতিঝর্ণা পাহাড়ে পেয়েছি গ্যাসের সংযোগও। পাহাড়ি এলাকায় গভীর নলকূপ বসানোর প্রমাণও পেয়েছি। কারা, কীভাবে এসব সংযোগ নিচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রেলওয়ে থেকে কিছু জমি ইজারা নিয়ে পুরো পাহাড় দখল করা হয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের নামে। হকার্স লীগ, সাংবাদিক ফোরাম, বাস্তুহারা সমিতিসহ বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় সংগঠনের নামে একের পর এক পাহাড় দখল করা হয়েছে।'
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী বলেন, 'মাসব্যাপী অভিযানের প্রথম দিনে আমরা ৩৫০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি। যারা এসব স্থাপনা করেছে তাদের প্রয়োজনে জরিমানাও করা হবে। কারা পাহাড়ে বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন সংযোগ দিচ্ছে সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রেলওয়ে থেকে কে, কীভাবে লিজ নিলো, সিটি করপোরেশন থেকে কারা রাস্তার অনুমোদন আনছে সেসবও যাচাই করা হবে। এ অভিযান চলবে আগামী মাস পর্যন্ত।'