ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা এবং সিলেটের গোয়াইনঘাটের নদনদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব এলাকায় বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। ফলে হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলের ক্ষেত। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন।
অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে গবাদি পশু নিয়ে নিরাপদ স্থান ও উঁচু রাস্তার ওপর আশ্রয় নিয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। এদিকে আকস্মিক বন্যায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে লাখো পানিবন্দি মানুষ। অথচ এসব বন্যাদুর্গতর কাছে এখনও পৌঁছায়নি সরকারি-বেসরকারি সহায়তা। অফিস ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
রংপুর :তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধিতে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় প্রায় পাঁচশ' পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণে গত বৃহস্পতিবার থেকে তিস্তা নদীর পানি বাড়তে থাকে। এতে উপজেলার সাত ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তার ১৫টি চরে বসবাসকারী প্রায় পাঁচশ' পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা পাকা রাস্তার প্রায় পাঁচশ' ফুট ভেঙে গেছে। সরেজমিন দেখা যায়, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ, চরইচলী, কোলকোন্দ ইউনিয়নের চিলাখাল, চর মটুকপুর, নোহালী ইউনিয়নের বাগডোহরা, চর নোহালী, কচুয়া এলাকার প্রায় পাঁচশ' পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় বিনবিনা এলাকায় কিছু লোক গবাদিপশুসহ রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী জাকারিয়া জানান, গতকাল শুক্রবার সকালে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
কুড়িগ্রাম, উলিপুর ও চিলমারী :জেলার নদনদী তীরবর্তী চর, দ্বীপচর ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৯ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ৩০ ঘণ্টায় ধরলার ফেরিঘাট পয়েন্টে ৬০ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী পয়েন্টে ৩৪ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৩৯ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে।
ব্রহ্মপুৃত্র, দুধকুমার ও গঙ্গাধর নদীবেষ্টিত সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানান, তার ইউনিয়নের ঝুনকারচর, ভগবতীপুর, কালির আলগা, গোয়ালপুরি, রলাকাটা, পোড়ারচর, চর পার্বতীপুর, চর যাত্রাপুর ও ঘনেশ্যামপুর- এই ৯ গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচগাছি ইউনিয়নের কদমতলা, উত্তর নওয়াবস, সিতাইঝাড়, গোবিন্দপুর, রেলবাজারের চর ও ছত্রপুর এবং ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের নানকার, নন্দদুলালের ভিটা, জগমোহনের চর, চর বড়াইবাড়ী ও মোগলবাসা ইউনিয়নের চর কৃষপুর প্লাবিত হওয়ায় প্রায় এক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা।
এদিকে উলিপুর উপজেলার আট ইউনিয়নের ৭০টি চরগ্রামের সাড়ে চার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যায় সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে হাতিয়া, বুড়াবুড়ি, সাহেবের আলঙ্গা, বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন। আংশিক তলিয়ে গেছে দলদলিয়া, গুনাইগাছ, থেতরাই ও বজরা ইউনিয়ন। হাতিয়া ইউনিয়নের দাগার কুঠি, নয়াগ্রাম, গুজিমারী, হাতিয়া ভবেশ, টারীপাড়া, হাতিয়া গ্রাম ও গুচ্ছগ্রামসহ ২০টি চরগ্রাম। বেগমগন্‌জ ও সাহেবের আলঙ্গা ইউনিয়নের ৫০টি চরগ্রাম সম্পূর্ণ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সাহেবের আলঙ্গা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সিদ্দিক হোসেন জানান, তার ইউনিয়নের শতভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অথচ বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো কিছু তাদের হাতে নেই বলে তিনি অসহায়।
অন্যদিকে চিলমারী উপজেলার অষ্টমীরচর ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম, নয়ারহাট ইউনিয়নের চারটি গ্রাম এবং রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নয়ারহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ খাউরিয়া এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে এবং দুইশ' বিঘা আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুটি ব্যারাক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অষ্টমীরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু তালেব ফকির জানান, পানিবন্দি মানুষের মাঝে এখনও সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কোনো সাহায্য দেওয়া হয়নি।
গাইবান্ধা :বিভিন্ন নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। ফলে এসব এলাকার হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে পাট, পটোল, কাঁচামরিচ ও শাকসবজির ক্ষেতসহ সদ্য রোপণ করা বীজতলা তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, কঞ্চিবাড়ী, বেলকা, হরিপুর, চণ্ডিপুর, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর বিভিন্ন চর এবং সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লারচর, গিদারী ফুলছড়ির এরেন্ডবাড়ী, উড়িয়া, ফজলুপুর, ফুলছড়ি, গজারিয়া, উদাখালী, সাঘাটার ভরতখালী, হলদিয়া, ঘুড়িদহ ইউনিয়নের বিভিন্ন চরে পানি উঠতে শুরু করেছে।
গোয়াইনঘাট (সিলেট) :ভারি বর্ষণ এবং ডাউকি, গোয়াইন ও সারী নদী দিয়ে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে বৃহস্পতিবার থেকে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের জাফলং চা বাগান, মমিনপুর, আসামপাড়া, আসামপাড়া হাওর, ছৈলাখেল অষ্টমখণ্ড (আংশিক এলাকা) নবমখণ্ড, সানকীভাঙ্গা, নয়াগাঙের পাড়, বাউরবাগ হাওর, ভিত্রিখেল হাওর, আলীরগাঁও ইউনিয়নের নাইন্দার হাওর, তিতকুল্লি হাওর, বুধিগাঁও হাওর, রাজবাড়ি কান্দিসহ পশ্চিম জাফলং, রুস্তমপুর, ডৌবাড়ী, লেঙ্গুড়া, তোয়াকুল ও নন্দীরগাঁও ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এতে উপজেলা সদরের সঙ্গে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে।