আওয়ামী লীগে গৃহদাহ, সুবিধা নিতে সক্রিয় জাতীয় পার্টি

আনোয়ার হোসেন মিন্টু, জামালপুর
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগে গৃহদাহ ততই বাড়ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের সঙ্গে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হোসনে আরা, পৌর মেয়র আ. কাদের শেখ ও উপজেলা চেয়ারম্যান নাসের বাবুলের বিরোধ অনেকটা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
হাইব্রিডদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতাকর্মী নীরবে দূরে সরে গেছেন। দলে নেতাকেন্দ্রিক বিভক্তি তৈরি হয়েছে। বিভক্তির কারণে হতাশ মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরা। দলীয় নীতি নির্ধারকদের অভিমত, দলে ঐক্য ফিরে না এলে আর গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনোনীত করতে না পারলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বড় খেসারত দিতে হবে। আওয়ামী লীগে বিভক্তির সুযোগে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি পৌঁছে যেতে পারে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত জামালপুর-২ আসন (ইসলামপুর)। এর পরও আসনটি দুইবার হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি এবং ২০০১ সালে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হন। স্বাধীনতার পর থেকে বাকি সময় আসনটি আওয়ামী লীগের দখলেই রয়েছে।
২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ফরিদুল হক খান। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের দিন ভোট কারচুপির অভিযোগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। সে সময় অনেকটা খালি মাঠে গোল দিয়ে নির্বাচিত হন ফরিদুল হক খান। বর্তমানে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
নেতাকর্মীর দাবি, প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই হাইব্রিড নেতাদের নিয়ে দল পরিচালনা, সরকারি বরাদ্দ বণ্টন বৈষম্যসহ নানা বিষয় নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বেড়ে গেছে। সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এক সময়ের সুসংগঠিত দলটি কয়েক ভাগে বিভক্ত। বর্তমান সংসদ সদস্যের ডাকে আগের মতো আর সাড়া দিচ্ছেন না নেতাকর্মীরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে ভোটের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হোসনে আরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি দলীয় কার্যালয়ে প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তাঁর এক অনুসারী নেতা তাঁকে লাঞ্ছিত করেন। ঘটনার সময় প্রতিমন্ত্রী ওই নেতাকে নিবৃত না করে উল্টো তাঁকেই ধমক দেন। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের স্পিকারকে জানিয়েছেন তিনি। এই ঘটনায় শত শত ক্ষুব্ধ নারী প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। এখন পর্যন্ত বিষয়টির কোনো সুরাহা না হওয়ায় দুই সংসদ সদস্যের বিরোধ রয়েই গেছে।
তিনবারের পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের শেখের সঙ্গেও নানা বিষয় নিয়ে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর তীব্র বিরোধ। এর জের ধরেই আগামী নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন মেয়র। প্রায় দিনই তার
কর্মী-সমর্থকরা মিটিং-মিছিল ও সমাবেশ করছেন। মেয়র নিজেও কর্মী-সমর্থক নিয়ে গণসংযোগ করে চলেছেন।
দলের যখন এমন হযবরল অবস্থা, তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নেতাকর্মী নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন উপজেলা চেয়ারম্যান জামাল আব্দুন নাসের বাবুলের ছোট ভাই সমাজসেবক শাহিনুজ্জামান শাহীন। এরই মধ্যে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীর সমন্বয়ে তাঁর পক্ষে শক্তিশালী একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা জিয়াউল হক জিয়াও তাঁর কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে দলীয় কর্মসূচিসহ গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। জিয়াউল হকের ভাষ্য, প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই ফরিদুল হক খান দলের ত্যাগী নেতাকর্মীকে দূরে সরিয়ে দেন। পরে বিএনপি-জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে দল পরিচালনা শুরু করেন। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জন্য ফরিদুল হক খানকে দায়ী করে তিনি বলেন, এর জন্য প্রতিমন্ত্রী নিজেই দায়ী।
উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জামাল আব্দুন নাসের বাবুলের সঙ্গেও প্রতিমন্ত্রীর সম্পর্ক সাপে-নেউলে। উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, তিনি চান সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। পক্ষান্তরে প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে তাঁর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেন। সংসদ সদস্যের সঙ্গে তাঁর এখানেই মতবিরোধ। যে কারণে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার দুই বছর পর থেকেই তাঁর সঙ্গে মতের প্রার্থক্য চলে আসছে। তিনি বলেন, প্রতিমন্ত্রী যে পথে হাঁটছেন সে পথ থেকে ফিরে এসে দলকে ঐক্যবদ্ধ করা জরুরি। তাঁর ভাষ্য, এ আসনে একজন গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন না দিলে আগামী নির্বাচনে দলের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের যখন এই অবস্থা, তখন আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জামালপুর জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শিল্পপতি মোস্তফা আল মাহমুদ। তিনি সমকালকে বলেন, গত সংসদ নির্বাচনেই তাঁর পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের আগে মহাজোটের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ায় তাঁকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। এবার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য ইসলামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান এমপির মোবাইল ফোনে কল দিলে রিসিভ করে প্রতিমন্ত্রীর ব্যস্ততার কথা জানান এপিএস (বেসরকারি) মনিরুজ্জামান।
কোন্দলের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম বলেন, ‘এখানে আওয়ামী লীগে কোনো গ্রুপিং নেই। তবে জাতীয় নির্বাচনে কয়েকজন এমপি প্রার্থী হতে চান। সেটা তো গ্রুপিং নয়, ব্যক্তিগত বিষয়।’ বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী নিয়ে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দল পরিচালনার বিষয়ে তাঁর ভাষ্য, এসব অভিযোগ সত্য নয়। তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, মাসখানেক আগে এক সভায় এক নারী সংসদ সদস্যকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছিল। এ বিষয়ে সমকালে একাধিক রিপোর্ট করেছেন। কিন্তু জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের পৃথক তদন্তে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। এ বিষয়ে আলাদা রেজুলেশনও হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে সমকালে কোনো রিপোর্ট দেখলাম না, যা দুঃখজনক।’