পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ভোক্তার পকেট থেকে এরই মধ্যে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অতিরিক্ত মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ী। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার আগেই দেশে পেঁয়াজের মজুদ ছিল কমপক্ষে পাঁচ লাখ টন। এর মধ্যে আমদানি করা পেঁয়াজ ছিল প্রায় এক লাখ টন। এগুলোর গড় আমদানি মূল্য ছিল ২৭ টাকা কেজি।
তবে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের খবরে এসব ব্যবসায়ী সুযোগ পেয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার টন পেঁয়াজের চাহিদা থাকলেও গত দু'দিনে তা ছিল পাঁচ-সাত গুণ বেশি। এটির সুযোগে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ভোক্তার পকেট থেকে তারা বাড়তি নিয়ে যায় ৬০ থেকে ৭০ টাকা। গত দু'দিনে বেচাকেনা হওয়া ২০ থেকে ২৫ হাজার টন পেঁয়াজ থেকে এভাবে শতকোটি টাকা বাড়তি মুনাফা করেছে তারা।
বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন বলেন, 'আমাদের দেশে এখন প্রায় পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ মজুদ আছে। গত তিন মাসে আমদানি হয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ টন। শুধু সেপ্টেম্বরে আমদানি হয়েছে ৪৪ হাজার টন। আগস্টে এলসি ওপেন হয়েছে ৭২ হাজার টনের, জুলাইতে এলসি হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার টনের। দেশি পেঁয়াজের যে সরবরাহ আছে তাও সন্তোষজনক। তারপরও আতঙ্কিত হয়ে বাড়তি দামে পেঁয়াজ কিনছে মানুষ। অতিরিক্ত মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ী এটিরই সুযোগ নিচ্ছে।' চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় তার প্রভাব এত তাড়াতাড়ি পড়ার কথা ছিল না। নতুন করে আমদানি করা পেঁয়াজে বাড়তি দাম মানা যেত। আগে আমদানি করা পেঁয়াজ কেন এখন খুচরা বাজারে ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হবে। এটির পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা খতিয়ে দেখা উচিত। পাশাপাশি অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির ওপর নজর দেওয়া উচিত।'
এদিকে, পেঁয়াজের সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে আগামী সপ্তাহে বাণিজ্য সচিব চট্টগ্রামে আসবেন বলে জানালেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। তিনি বলেন, পেঁয়াজের মূল বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন বেনাপোল, সোনামসজিদ ও ভোমরাকেন্দ্রিক আমদানিকারকরা। খাতুনগঞ্জে আছে এই আমদানিকারকদের কমিশন এজেন্ট। অবশ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েও কিছু পেঁয়াজ আসে প্রতি মাসে। মন্ত্রণালয় পুরো বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছে। কেন হঠাৎ করে দাম বাড়ল; কারা এর সঙ্গে জড়িত- সব বিষয় আমলে নিয়ে এগোচ্ছেন তারা।
ভোক্তার পকেট থেকে হাওয়া শতকোটি টাকা : বাংলাদেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। উৎপাদন হচ্ছে ২৩ লাখ টন। কিন্তু ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বছরে ঘাটতি থাকে ৮ থেকে ৯ লাখ টন। এই ঘাটতি মোকাবিলায় আমদানি করা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী চট্টগ্রাম, বেনাপোল, হিলি, সোনামসজিদ, ভোমরা ও টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে গত জুন থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার টন পেঁয়াজ। এসব পেঁয়াজে সব রকমের শুল্ক্ক দিয়ে কেজিপ্রতি দাম পড়েছে মাত্র ২৭ টাকা ৪৫ পয়সা। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ এসেছে সোনামসজিদ দিয়ে ৭৪ হাজার ৭৪০ টন। হিলি দিয়ে এসেছে ৫৬ হাজার ৬১৩ টন। বেনাপোল দিয়ে আসে ১৪ হাজার ৬৫৮ টন। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এসেছে এক হাজার ৮২৪ টন। টেকনাফ দিয়ে আসে ১৩৭ টন পেঁয়াজ।
আমদানি করা এসব পেঁয়াজের বড় অংশ এখনও আছে দেশের বিভিন্ন মোকামে। ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় রাতারাতি দাম বাড়ানো হয়েছে এসব পেঁয়াজেরই। প্রতি কেজি পেঁয়াজে পাইকারি ও খুচরা বাজারে ভোক্তার কাছ থেকে বাড়তি নেওয়া হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত মুনাফা করা হয়েছে শতকোটি টাকা।
বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ :বাংলাদেশে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে ১৯ হাজার ৮৪৩ টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। মঙ্গলবার একদিনেই ব্যবসায়ীরা ১০ হাজার ৭০০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্রের (আইপি) জন্য আবেদন করেছেন। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বুলবুল জানান, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ভারতের বিকল্প হিসেবে চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার, তুরস্ক ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছেন। ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৪টি অনুমতিপত্র বা আইপির মাধ্যমে ১৯ হাজার ৮৪৩ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- খাতুনগঞ্জের আবুল বাশার অ্যান্ড সন্স ৫০০ টন পাকিস্তান থেকে, রেড লিংক মিসর থেকে ১ হাজার টন, পাকিস্তান থেকে এএস করপোরেশন ৫০১ টন, মিয়ানমার থেকে এসএন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৫০০ টন, এএইচ এন্টারপ্রাইজ চীন থেকে ৫০০ টন ও মিয়ানমার থেকে ৫০০ টন, চীন থেকে এ মোক্তার ট্রেডিং ৫০০ টন, মিয়ানমার থেকে খাতুনগঞ্জ ট্রেডিং ৫০০ টন, পাকিস্তান থেকে এস ইসলাম ট্রেডিং ৪০০ টন।
গতকাল দুপুর পর্যন্ত অন্তত ২৫ জন ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানির আবেদন করেছেন বলে জানান আসাদুজ্জামান বুলবুল। এসব পেঁয়াজ দেশে এলে বাজার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও।


বিষয় : পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট

মন্তব্য করুন