মরতে বসেছে রংপুরের বুড়াইল নদী। নদী দখল করে পুকুর বানানো, প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়াসহ অপরিকল্পিতভাবে সরকারি অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে এ নদীর বুকে। ফলে দিন দিন মানচিত্র থেকে হারাতে বসেছে এক সময়ের প্রমত্তা এ নদী। প্রবাহ না থাকায় নদীপাড়ের মানুষের হাজার হাজার একর জমি বর্ষা মৌসুমে জলমগ্ন থাকছে। ফলে এক মৌসুমের ফসল কৃষকদের ঘরে উঠছে না। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া নদীগুলো বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে অচিরেই নদীমাতৃক এ দেশ নদীহীন দেশে পরিণত হবে।
জানা যায়, রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ নায়রার বিল থেকে উৎপন্ন হয়ে পীরগাছা উপজেলার বড়দরগা নামক এলাকায় গিয়ে আলাইকুমারী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে বুড়াইল নদী। প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীটির প্রস্থ স্থানভেদে ৫০ থেকে ৬০ ফুট। এ নদীর প্রবাহ মৌসুমি। বর্ষাকালে অধিক বৃষ্টিপাত হলে নদীটির দু'কূল প্লাবিত হয়। স্থানীয়দের মতে, গত ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে বুড়াইল নদীতে সারাবছর পানি থাকত। সেই সঙ্গে নদীর গভীরতা ছিল বেশ।
রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কে নন্দীগঞ্জ পার হলে ব্রিজ থেকে দেখা মেলে বুড়াইল নদীর। কাউনিয়া মহাসড়কের বুক চিরে পীরগাছার দিকে প্রবাহিত হয়েছে এ নদী। কিছুদূর সামনে যেতেই নদীটি ভয়াবহ দখলের শিকার হয়। ধাপে ধাপে নদীর বুকে পুকুর বানিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। স্থানীয়দের অভিযোগ- জলিল হাজি, মোফা মাস্টার, মোস্তফা, কালাম, ফজল মাস্টার, রহিম মাস্টারসহ বেশ কয়েকজন বুড়াইল নদী দখল করে পুকুর বানিয়েছেন। নদীর প্রবাহ বন্ধ করে তৈরি করছেন মাছের প্রকল্প।
সরেজমিন দেখা যায়, পীরগাছার আমতলী বাজার সংলগ্ন এলাকায় সড়ক ঘেঁষে দেখা মেলে বুড়াইল নদীর। আমতলীর বাজার সংলগ্ন একটি কালভার্টের নিচ দিয়ে পীরগাছার দিকে প্রবাহিত হয়েছে এ নদী। তবে দেখে বোঝার উপায় নেই এটি নদী। রাস্তার দু'ধারে নদীর প্রবাহ বন্ধ করে জলিল হাজি বুড়াইল নদীকে পুকুর বানিয়েছেন। বিশাল আকারের পুকুরে করছেন মাছ চাষ। রাস্তার ধারে পুকুরপাড়ে মাচায় দুলছে কুমড়া, পুকুরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে হাঁস। রাস্তার দু'ধারে জলিল হাজির পুকুর থাকায় একরকম বলা যায়, সরকারি কালভার্টটি জলিল হাজির পুকুরের ওপরে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে জলিল হাজি নদীটিকে পুকুর হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। প্রবাহ বন্ধ থাকায় অতিবৃষ্টি হলে আশপাশের ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষেতে পানি উঠছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার যাতনা সইছেন ভুক্তভোগী তিন শতাধিক পরিবার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার চেষ্টা করা হয়েছে একাধিকবার। তবে নদী দখলকারী জলিল হাজিসহ অন্যরা প্রভাবশালী হওয়ায় তা সমাধানের পর্যায়ে যায়নি। কাউনিয়া উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নে গোড়াই এলাকায় বুড়াইল নদীর ওপরে প্রায় দুই বছর আগে একটি ব্রিজ বানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। নতুন ব্রিজের নিচে পানি প্রবাহের জন্য করা হয়েছে দুটি গোলাকার মুখ। ফলে নদীর পানি প্রবাহে বিঘ্ন ঘটছে। এতে করে গোড়াই এলাকার হাজার হাজার একর আমন ক্ষেত পানিতে তলিয়ে আছে। ফসলি জমি বর্ষাকালে পরিণত হয়েছে বিলে।
গোড়াই এলাকার কৃষক তোফাজ্জল হোসেন (৬৫) বলেন, পুরোনো ব্রিজের নিচ থেকে আগে অবাধে পানি প্রবাহিত হতো। কিন্তু দু'বছর আগে নতুন ব্রিজ তৈরির পাশাপাশি পানি যাওয়ার জন্য ব্রিজের নিচে দুটি নালা তৈরি করা হয়েছে। ফলে ওই জায়গা দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে না। এতে করে আমাদের কয়েক হাজার একর আমনের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে আছে। আমাদের এ দুঃখ যেন দেখার কেউ নেই।
আমতলী বাজার এলাকার আলমগীর হোসেন (২৮) বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীকে পুকুর বানিয়েছেন। ফলে বৃষ্টি হলেই নদীর পানি উপচে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ঘরের আসবাবপত্র প্রতি বছর পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বাররা নদী দখলকারীদের বিচার করতে সাহস পান না। সরকারের উচিত নদীকে নদীর মতো চলতে দেওয়া।
অন্য ভুক্তভোগী রুবিনা আক্তার (২৪) বলেন, বর্ষাকাল এলে আমাদের ফসলের ক্ষেত ও ঘরবাড়িতে পানি ওঠে। নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ করায় বৃষ্টির পানি উপচে আশপাশের বাড়িগুলোতে চলে আসে। যারা নদী দখল করে এমন জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, দখলদাররা বুড়াইল নদীর উজান ও ভাটিতে দু'দিকেই পাড় দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ রেখেছেন। দিনদুপুরে তারা নদী দখল করে মাছের প্রকল্প গড়েছেন। এদের আগে আইনের আওতায় এনে শাস্তিসহ সরকারি সম্পদ বিনষ্টের জন্য জরিমানা করতে হবে। দখলদারদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ দিয়ে দখল উচ্ছেদ করতে হবে সরকারকে। সেই সঙ্গে নদীপাড়ের মানুষ যদি না জাগে, তবে নদী রক্ষা করা যাবে না। এভাবে চলতে থাকলে নদীমাতৃক দেশ একসময় নদীহীন দেশে পরিণত হবে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান সমকালকে বলেন, রংপুর জেলায় কালের বিবর্তনে অনেক নদী হারিয়ে গেছে। অনেক নদী এখনও রয়েছে, তবে সেগুলো অবৈধ দখলের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। যেসব নদী এখনও বিদ্যমান, সেই নদী উদ্ধারসহ প্রবাহ ঠিক রাখতে একটি কমিটির মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়েছে। আশা করি দ্রুতই আমরা বিদ্যমান নদীগুলো সংরক্ষণ ও দখল-উচ্ছেদ করতে পারব।



বিষয় : বুড়াইল নদীর শ্বাসরোধ

মন্তব্য করুন