'দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ' বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের চিত্র। কিন্তু সিলেটের পর চট্টগ্রাম কিংবা পঞ্চগড়ের পর বৃহত্তর ময়মনসিংহও হতে চলেছে সেই দেশ। চায়ের নতুন ঠিকানা হতে যাচ্ছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ। এর মধ্যেই ব্যক্তি উদ্যোগে পরীক্ষামূলক চাষাবাদের মধ্য দিয়ে নতুন এ ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে চা গাছ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রসেসিং কারখানা পেলে এ অঞ্চলে চা চাষের বিপুল সম্ভাবনা হয়ে উঠবে বাস্তব।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা সদর থেকে অন্তত ২০ কিলোমিটার ভেতরের গ্রাম বিজয়পুর। এখানেই ব্যক্তি উদ্যোগে চা চাষ করেছেন মো. আবুল হাশিম। অবশ্য তার মূল বাড়ি পাশের ঘোগা ইউনিয়নের চারিপাড়া গ্রামে। নিজের একটি লেবু বাগানের পাশে ২০ শতক জমিতে ২০১৯ সালের মার্চ-এপ্রিলে এক হাজার চারা নিয়ে পরীক্ষামূলক চা চাষ শুরু করেন তিনি। হাশিমের চাচা হযরত আলীর বাড়ি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার শরিয়ালজুঁত গ্রামে। অন্তত সাত বছর ধরে আড়াই একর জমিতে চা চাষ করে বিপুল অর্থকড়ি কামিয়েছেন হযরত আলী। চাচার সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সমতলের এ অঞ্চলে চা চাষের পরিকল্পনা নিয়েছেন আবুল হাশিম।

চায়ের চাষাবাদে যুক্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে ২০১৮ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে জমির মাটির উপযোগিতা পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর চায়ের চাষাবাদ শুরু করেন আবুল হাশিম। প্রতিটি চারা ২০ টাকায় কিনে পঞ্চগড় থেকে বিজয়পুর গ্রামে রোপণ করেন তিনি। বছর না পেরুতেই চা গাছের ঈর্ষণীয় বিকাশে আরও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি।

গত সোমবার সম্ভাবনাময় নতুন চায়ের গ্রাম বিজয়পুর ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবুল হাশিমের চাষাবাদের অগ্রগতি দেখে পাশাপাশি এলাকার তোতা মিয়া ও মো. রফিকুল ইসলাম প্রত্যেকে এক হাজার; নাছির মিয়া, কালু মিয়া, হায়দার আলী ও ইলিয়াস মেম্বর ২০০ এবং শহীদুল ইসলাম ৩০০ চায়ের চারা রোপণ করেন। তাদের বাগানে চা গাছের দ্রুত বৃদ্ধিও ঘটেছিল। কিন্তু উৎপাদিত চা পাতা বিক্রির মতো কোনো সুবিধা ও ব্যবস্থাপনা না থাকায় তাদের পাঁচজনই তিন মাস আগে তাদের চা বাগান কেটে ফেলেছেন। একজনের বাগান অবশ্য নষ্ট হয়েছে জলাবদ্ধতায়।

চাষি হায়দার আলীর স্ত্রী মিনারা বেগমের সঙ্গে কথা হয় তার বাড়িতে। তিনি বলেন, হাশিমের চা বাগান দেখে তারাও ২০০ চারা কিনে লাগিয়েছিলেন। অনেক বড়ও হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো কেনার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, চা পাতা তো এখানকার বাজারে বেচা যায় না। অন্য ফসল করলে বাজারে বেচে টাকা পাওয়া যায়। সংসার চলে। তাই জমিতে এখন লাউগাছ লাগানো হয়েছে। তবে কখনও কারখানা হলে আবার চা চাষ করবেন বলে জানান তিনি। একই কথা জানান অন্য চা চাষিরাও।

চা চাষি মো. আবুল হাশিম জানান, এ অঞ্চলের মাটির গুণাগুণ চা চাষের উপযোগী। চা গাছ দ্রুত বড় হয় এখানে। আগামী বছর থেকে তিনিই চারা উৎপাদনের চেষ্টা করবেন। এলাকায় চা চাষের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও চা প্রসেসিং কারখানা না থাকায় তাদের কাছ থেকে পাতা নেওয়ার কেউ নেই। গ্রামের দরিদ্র কৃষকরা চা চাষ করলেও বিক্রির জায়গা নেই। বিক্রি করার মতো কারখানা হলে এ অঞ্চলে অন্তত ৫০০ একর জমিতে চা চাষ হবে। তিনি নিজেই ১০০ একর জমিতে চা চাষ করবেন। তিনি আরও জানান, বর্তমানে হ্যান্ড মেড টি নিজেরা পান করছেন, স্বজনদেরও দিচ্ছেন। চা খুবই লাভজনক ফসল। বছরে ৫-৭ বার গাছ থেকে পাতা বিক্রি করা যাবে। সরকারি উদ্যোগে চা প্রসেসিং মিল বসানো হলে এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করা যাবে। চাষিদের প্রশিক্ষণ ও বিনামূল্যে চারার ব্যবস্থা করতে হবে। সম্প্রতি চা বোর্ডের লোকজন তার বাগান পরিদর্শন করে গেছেন।

চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গারো পাহাড়ের এলাকা ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলায় অর্থকরী ফসল চা উৎপাদনের মতো প্রায় ১৪ হাজার একর জমি রয়েছে। এসব জমিতে চা চাষ হলে বছরে এক কোটি ৬৩ লাখ কেজি চা উৎপাদন হবে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে ছোট পরিসরে চা চাষ বাড়াতে নতুন একটি প্রকল্প নিয়েছে চা বোর্ড। এক হাজার ২৩৫ একর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারণে ৭৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকার এ প্রকল্প আছে অনুমোদনের অপেক্ষায়।

২০০৪ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় প্রথম চা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এ অঞ্চলের মাটির গুণাগুণ ও আবহাওয়া চা চাষের অত্যন্ত উপযোগী। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকায় এক হাজার ১২০ একর, শেরপুর জেলার শ্রীবর্দীতে এক হাজার ১৫০ একর, ঝিনাইগাতীতে এক হাজার ৮৫৫ ও নালিতাবাড়ীতে আড়াই হাজার একর; জামালপুরের বকশীগঞ্জে ৬০০ একর, নেত্রকোনার দুর্গাপুরে এক হাজার ৭৭০ একর ও কলমাকান্দায় এক হাজার ৫০ একর- মোট ১০ হাজার ৪৫ একর জমিতে চা আবাদ সম্ভব। এর পর চা বোর্ড আরও একটি প্রকল্পের অধীনে এ অঞ্চলে জরিপ করে। এতে দেখা যায়, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় ৩০০ একর, ফুলবাড়িয়ায় ৫০০ একর, ভালুকায় ৪০০ একর ও টাঙ্গাইলের মধুপুরে ৬০০ একর, ঘাটাইলে ৫০০ একর এবং সখীপুরে ৫০০ একর জমিতে ছোট পরিসরে চা চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের পাঁচ জেলার ১৫টি উপজেলায় মোট ১৩ হাজার ৬৪৫ একর জমিতে চা আবাদ সম্ভব।

সম্প্রতি চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলীসহ পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম শেরপুরের শ্রীবর্দী, ঝিনাইগাতী, নকলা ও নালিতাবাড়ী এবং ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার বিভিন্ন চা বাগান সরেজমিন পরিদর্শন করে ও চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়।

চা উন্নয়ন বোর্ডের নর্দার্ন বাংলাদেশ প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, দেশে যে পরিমাণ চা উৎপাদন হয়, তাতে দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা যায় না। ক্ষুদ্র পরিসরে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ১৫টি উপজেলায় চা চাষের বিস্তারে ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন হয়ে একনেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে। আশা করা হচ্ছে, এটি প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেবেন। তিনি বলেন, প্রকল্পের আওতায় ৮৯ লাখ চারা বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। চাষিদের প্রশিক্ষিত করে তোলা হবে। এবং চাষের পর তিন বছর কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হবে। এ ছাড়া পাঁচ জেলার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি চা প্রসেসিং কারখানা করা হবে। সরকারি খরচে পরিবহনের মাধ্যমে অন্যান্য জেলা থেকে কৃষকদের জমি থেকে চা পাতা কারখানায় আনা হবে। এতে কর্মসংস্থান হবে অনেক মানুষের।