আ’লীগের নেতাকর্মী দিয়ে অধ্যক্ষকে অপহরণ এমপির

সৈয়দ করম আলী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৬:৫৯ | আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৬:৫৯
তুলে আনার হুমকির এক দিন পর মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে সন্ত্রাসী কায়দায় অপহরণ করে সংসদ সদস্য ডা. মনসুর রহমানের বাড়িতে তিন ঘণ্টা আটকে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপহৃত শিক্ষক হাবিবুর রহমান রাজশাহীর পুঠিয়ার বিড়ালদহ সৈয়দ করম আলী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ।
সোমবার মাদ্রাসা থেকে ছাত্রছাত্রীদের সামনে থেকেই তাঁকে তুলে নিয়ে যান আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতাকর্মী। গাড়ির ভেতরেই তাঁকে মারধর করেন তারা।
এ সময় তাঁর মুক্তির দাবিতে বিড়ালদহে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক প্রায় ২০ মিনিট অবরোধ করেন শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা। বিক্ষোভের মুখে তিন ঘণ্টা পর পুলিশ দিয়ে অধ্যক্ষকে মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
রাজশাহী-৫ পুঠিয়া-দুর্গাপুর আসনের এমপি ডা. মনসুর রহমানের ফাঁস হওয়া অডিওতে শোনা যায়, ‘হ্যালো? (এমপি) অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান সাহেব বলছেন? আমি ডা. মনসুর রহমান এমপি। (অধ্যক্ষ) জি? কোন জায়গা থেকে বলছেন? হ্যালো? বুঝি না! আমি ডা. মনসুর রহমান এমপি। আপনি কাল রাত ৯টার সময় আমার বাসায় দেখা করবেন। আসবেন তো, না নিয়ে আসতে হবে? (অধ্যক্ষ) হ্যাঁ, কী দরকার আমার সঙ্গে আবার? আপনি প্রিন্সিপাল মাদ্রাসার– আমি এলাকার এমপি। আপনাকে ডাকতেছি আপনি আসবেন। যদি না আসেন ঘাড় পাকিয়ে আপনাকে তুলে নিয়ে আসব। (অধ্যক্ষ) তাই? এমপি– জি, শুইনা রাখেন।’
অপহরণের শিকার অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান বলেন, মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির মেয়াদ শেষ হলে নতুন কমিটি গঠন করি। এ নিয়ে এমপি ডা. মনসুর রহমান ক্ষুব্ধ হয়ে ১৪ অক্টোবর রাত ৯টায় ফোন করে বলেন, ‘এখনই আমার বাসায় আসেন। আমি জানাই, আমি তো পাবনায়– গ্রামের বাড়িতে। ফিরব ১৫ তারিখ ভোরে। তখন এমপি বলেন, তাহলে কাল রাতে আসেন। আসতে পারবেন তো? না আসতে পারলে ঘাড় পাকিয়ে তুলে আনব।’
তিনি আরও বলেন, এর এক দিন পর সোমবার সকাল ৯টায় এমপির সন্ত্রাসী বাহিনী শফিকুল ইসলাম ডাবলু, মুহিন, তুষারসহ পাঁচজন আমাকে জোর করে একটি মাইক্রোবাসে তোলে। এ সময় তারা আমাকে কিল-ঘুসি দিতে থাকে। তারা জোর করে তুলে আমাকে এমপির বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর তারা ডা. নওশাদ আলীকে এমপির বাসায় আসার জন্য ডাকে। তবে নওশাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কমিটি নিয়ে আমাকে এমপি সাহেব জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। পরে অবশ্য তুলে আনার জন্য ভুল স্বীকার করেন। মিষ্টি খাইয়েছেন। ছবিও তুলেছেন। মুহিনকে দিয়ে ক্ষমা চাইয়েছেন। এমপিও ভুল স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় এখন মামলা করব কিনা স্থানীয় লোকজন, অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। এত বড় একটা ঘটনা, আইনের আশ্রয় না নিলে হবে?
জানতে চাইলে এমপি ডা. মনসুর রহমান সমকালকে বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদের বাড়ি বিড়ালদহে। আমি তাঁকে সভাপতি করেছিলাম। কিন্তু অধ্যক্ষ আমাকে না জানিয়ে গোপনে নওশাদকে বাদ দিয়ে দারার (সাবেক এমপি এবং রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল ওয়াদুদ) লোককে সভাপতি করেছে। এ জন্য তাঁকে ফোন করেছিলাম। পরে কিছু লোক তাঁকে তুলে এনেছিল। অধ্যক্ষ এসেই বললেন– খুব ক্ষুধা লেগেছে খেতে দেন। আমি তাঁকে মিষ্টি খাইয়েছি। পরে তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পুলিশ ডেকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।
অধ্যক্ষকে ঘাড় পাকিয়ে তুলে আনার হুমকির বিষয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের হুমকি আমি দেইনি। এসব দারার কারসাজি। দারা কেমন লোক তা তো জানেন?
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ডা. নওশাদ আলী বলেন, আমি মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলাম। তখন অধ্যক্ষের নামে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁকে সেই টাকা কলেজ ফান্ডে জমা দিতে নির্দেশ দিই। কিন্তু সে টাকা জমা দেয়নি। পরে আমার কমিটির মেয়াদ শেষ হলে এমপি ডা. মনসুর রহমান আমাকে ফের সভাপতি করতে আবারও ডিও দেন। কিন্তু ডিও অসম্মান করে অধ্যক্ষ স্থানীয় এক ছেলেকে গোপনে সভাপতি করে আনেন। বিষয়টি প্রকাশ হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তদন্ত করেন। এর পর সেই নতুন কমিটি বাতিল করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়।
বিড়ালদহ সৈয়দ করম আলী ফাজিল মাদ্রাসার নতুন সভাপতি আব্দুস সালেক বলেন, আমি আমার যোগ্যতায় সভাপতি হয়েছি। আমাকে দারা সভাপতি করেননি। কিন্তু মাদ্রাসা চালু অবস্থায় শিক্ষার্থীদের সামনে দিয়ে অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করে তুলে নিয়ে যাওয়া খুবই ন্যক্কারজনক ঘটনা। এ ঘটনার উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি। আমরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছি। এর পর অধ্যক্ষকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘটনা জানতে পুঠিয়া থানার ওসিকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান বলেন, ‘এমপি সাহেব অধ্যক্ষকে ডেকেছিলেন। পরে তিনি গিয়েছিলেন। তুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’