কিশোরগঞ্জ-৫
দুর্নীতি দখল পরিবারতন্ত্রের জাল এমপি আফজালের

হকিকত জাহান হকি
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ০০:৫২ | আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ০২:৪৭
শের অনেক এমপির বিরুদ্ধেই স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তবে কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের সরকারদলীয় এমপি আফজাল হোসেন এ ক্ষেত্রে অনেক ধাপ এগিয়ে। নিজ এলাকায় তিনি যেভাবে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা অনেকের চিন্তারও বাইরে। তিনি এক ভাইকে বানিয়েছেন পৌরসভার মেয়র, আরেক ভাইকে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া শ্যালক, ভাগনেসহ আরও অনেক আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছেন। দলেও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন তাদের।
এভাবে দুই উপজেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে দখলবাজি আর দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছেন তিনবারের এমপি আফজাল। এর মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। তাদের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার এলাকার মানুষ। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও এখন তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ চান। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও চেয়েছেন তারা। সরেজমিন অনুসন্ধানে মিলেছে এসব তথ্য।
এমপি আফজালের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন আশরাফ বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র। এলাকার মানুষ বলছেন, এই দুই ভাই বাজিতপুর-নিকলী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। আফজাল ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের এমপি। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে লাগামহীন দুর্নীতি ও প্রভাব খাটিয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে তারা এরই মধ্যে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তাদের নানা অপকর্মের কথা এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে।
বাজিতপুর-নিকলীর রাজনৈতিক নেতারা সমকালকে বলেন, আফজাল ও আশরাফের দাপটে স্থানীয় রাজনীতিতে কেউ দাঁড়াতে পারছেন না। এলাকার রাজনীতির সব ক্ষেত্রে আত্মীয়করণ করা হয়েছে। এমপি নিজেই প্রভাব খাটিয়ে বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ধরে রেখেছেন। আর আশরাফকে করেছেন বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র। একইভাবে বাজিতপুরের হেলালপুর ইউনিয়নে এমপির ভাই গোলাম কিবরিয়া নবেল ও বলিয়াদী ইউনিয়নে ভাগনে আবুল কাশেমকে (কালা কাশেম) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। এমপি আফজালের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আবদুল হক জুয়েল গাজীরচর ইউনিয়ন এবং শ্যালক ওমর ফারুক রাসেল আলীমপুর ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হয়েছেন।
এখানেই শেষ নয়। এমপি আফজাল তাঁর বেয়াইয়ের ছেলে জাফর ইকবালকে পিরীজপুর ইউনিয়ন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হাবিব মিঞাকে কৈলাগ ইউনিয়ন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ একজনকে হুমাইপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বানিয়েছেন।
মেয়র আশরাফ বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। তাদের আরও দুই ভাইকে উপজেলা কমিটির সহসভাপতি এবং বন ও পরিবেশ সম্পাদক করা হয়েছে।
একইভাবে নিকলী উপজেলায় কারার পরিবারকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। এই পরিবারের সদস্যদের উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বহু পদ দেওয়া হয়েছে। কারার সাইফুল ইসলামকে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান করা হয়েছে। কারার শাহরিয়ার তলিবকে বানানো হয়েছে নিকলী উপজেলা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।
দখল-দুর্নীতি
বাজিতপুর উপজেলায় সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জমি আত্মসাৎ করেছেন এমপি ও মেয়র। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ওই জমি নিজেদের দখলে নিয়ে দুই ভাই সেখানে মার্কেট নির্মাণ করছেন।
এলাকার বেঙ্গলা নদী এমপি ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা ভাগাভাগি করে খাচ্ছেন। বাজিতপুর, সরারচর, দিলালপুর, পিরীজপুরসহ অনেক বাজারে নামকাওয়াস্তে ইজারা নির্ধারণ করে নিজেরাই দখলে রেখেছেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে, যে বাজারের ইজারার ডাক হওয়ার কথা ৬০ লাখ টাকা, সেখানে ইজারা দেন ২০ লাখ।
এলাকার রাস্তাগুলোর নির্মাণকাজের ঠিকাদারি কাজ পান এমপির আত্মীয়স্বজনরাই। ফলে কাজ মানসম্মত হয় না। যে রাস্তা পাঁচ বছর টেকার কথা, তা ছয় মাসেই নষ্ট হয়ে যায়। বিল-হাওর নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করছেন তারা।
দুই ভাই প্রভাব খাটিয়ে এলাকার বিভিন্ন জলমহাল থেকে অর্থ লুটে নিচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে– বেঙ্গলা চরবাদা, কইয়া খায়রা, মাইজচর, বাহেরবালী, হুমাইপুর, ঘোড়াউত্রা নদী জলমহাল।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, এমপি বাজিতপুরের নোয়াপাড়া গ্রামে নিজের বাড়িটি নির্মাণ করেছেন দখল করা জমিতে। আফজাল এমপি হওয়ার পর প্রতিবেশীদের সরিয়ে দিয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে তিনতলা পাকা বাড়ি করেন।
আরও বহু জায়গা দখলের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এলাকার বসন্তপুর মৌজায় সিনামহলের সামনে সরকারি জমিতে পাঁচটি দোকান বানিয়েছেন। দড়িঘাগটিয়া মৌজায় সিনামহলের প্রায় ১৫ শতাংশ জমি, বাজিতপুর বাজারে নাপিত মহলের পুকুর, বাজিতপুর পৌরসভার দড়িঘাগটিয়া মৌজায় প্রায় ২ একর জমি দখল এবং বসন্তপুর মৌজায় প্রায় ২৫ শতাংশ জমিতে তিনতলা মার্কেট তৈরি করেছেন।
দড়িঘাগটিয়া মৌজায় সিনামহলের প্রায় ১৫ শতাংশ জমি, দড়িঘাগটিয়া মৌজায় পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের দক্ষিণ পাশে প্রায় ২ একর জমি, নান্দিনা আলিয়াবাদ মৌজায় ব্যাপারীপাড়ার প্রায় ২০ শতাংশ জমি, তাতলচর মৌজায় বাজিতপুর দিলালপুর রাস্তার পশ্চিম পাশে প্রায় ৬০ শতাংশ জমি, গাজীরচর মৌজায় প্রায় ৮ একর জমি, শশেরদীঘি মৌজায় প্রায় ১০ একর ধানি জমি দখল করেছেন তারা।
এ ছাড়া বাজিতপুর মৌজায় মতুরাপুর গ্রামের পূর্ব পাশে বাবর আলীর বাড়ির পশ্চিম পাশে ২০ শতাংশ জমি করেছেন। দীঘিরপাড় মৌজায় মসজিদের ফেরিঘাটের পাটুলীর উত্তর পাশে ২০ শতাংশ জায়গায় দোকান নির্মাণ এবং ভাগলপুর মৌজায় মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল মিয়ার জমি দখল করেছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, এমপি আফজালের নামে-বেনামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফ্ল্যাট, শেয়ার, একাধিক গাড়ি রয়েছে। একাধিক ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রয়েছে।
এমপির ভাষ্য
আপনি নিজে এমপি, আপনার ছোট ভাই মেয়র, শ্যালকসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন চেয়ারম্যান– স্থানীয় রাজনীতি আপনারাই কুক্ষিগত করে রেখেছেন। এ অভিযোগের জবাবে এমপি বলেন, ‘কথাগুলো একদিকে সত্য, আরেকদিকে এসবের কোনো বাস্তবতা নেই। আমার ভাই মেয়র। পৌরসভার সব নেতা সম্মিলিতভাবে তাকে জোর করে মেয়র নির্বাচিত করেছেন।’
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সরকারি জায়গার জাল দলিল করে মার্কেট করেছেন– এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, তিনি নির্মল রাজনীতি করেন। অন্যায় করেন না, অন্যায় করতেও দেন না। তিনি কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না। তাঁর বিরুদ্ধে এসব অসত্য কথা বলা হচ্ছে। এলাকার বিল, হাওর, নদী দখলের জবাবে বলেন, অনেকে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে চায়। কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার পর অনিয়ম করলে তা জানালেও আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
আওয়ামী লীগে ক্ষোভ
আফজাল ও আশরাফের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহাম্মদ সমকালকে বলেন, এমপি আফজাল ও তাঁর ভাই আশরাফ প্রভাব খাটিয়ে বাজিতপুর-নিকলী আসনটিকে পরিবারতন্ত্রে রূপ দিয়েছেন। সবকিছু নিজেদের করায়ত্ত করতে যা যা করা দরকার, তারা তার সবই করছেন। তাদের লুটপাটের কথা বলে শেষ করা যাবে না। লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করতে দুই ভাই মিলে এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের দুর্নীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, পুরো বাজিতপুরটাই যেন এমপির বাড়িতে পরিণত হয়েছে। দলের ত্যাগী নেতাকর্মী কাউকেই দলীয় কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রাখেননি। নিজের পরিবারের সদস্য, স্থানীয় বিএনপি ও তাঁর অনুগত কিছু হাইব্রিড লোকজনকে ধরে এনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
পিরীজপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ী হারুনুর রশীদ সুমন সমকালকে বলেন, ‘আমরা পরিবর্তনের জন্য বাজিতপুর-নিকলীতে সভা-সমাবেশ করছি। বর্তমান এমপি, তাঁর ভাই, ভাগনে, শ্যালকদের টেনে এনে গুরুত্বপূর্ণ পদপদবিতে বসিয়ে বাজিতপুর-নিকলীর রাজনীতি ধ্বংস করে দিয়েছেন। এই এলাকার আওয়ামী লীগকে ভেঙে ব্যক্তিগত লীগ বানিয়েছেন। বর্তমান এমপি তাঁর আত্মীয়স্বজনকে প্রতিষ্ঠিত করে এলাকার রাজনীতিকে কুক্ষিগত করেছেন। এ কারণেই বাজিতপুর-নিকলীর মানুষ পরিবর্তনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, এমপি আফজাল হোসেনকে ঠেকাতে এবার এলাকার চার নেতা মাঠে নেমেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষক লীগের সাবেক সহসভাপতি ফারুক আহাম্মদ, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য রফিকুন্নবী সাথী ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক সুব্রত পাল এ আসনে আগামী নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হতে আগ্রহী।