খুলছে স্বপ্নের দুয়ার

টানেল যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তাই নতুন সাজে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী তীর। বৃহস্পতিবার দুপুরে তোলা - মো. রাশেদ
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০
দুয়ার খোলার প্রহর গুনছে দেশের প্রথম টানেল। স্বপ্ন ছোঁয়ার অপেক্ষায় বাণিজ্যিক রাজধানী। কর্ণফুলী নদীতীরে কান পাতলে শোনা যায় জনপ্রিয় সেই গান– ‘আমরা করবো জয়.../আহা বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়/আমরা করবো জয় নিশ্চয়।’ নদীর নিচ দিয়ে তৈরি টানেল গতি বাড়াবে শিল্পায়নের। দূরত্ব কমাবে চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের। কমবে পণ্য পরিবহন ব্যয়; সাশ্রয় হবে সময়। এমন প্রত্যাশায় দুই তীরে এখন সাজ সাজ রব। নানা রঙে সাজছে নগর। আগামীকাল শনিবার চট্টগ্রাম এসে স্বপ্নের দুয়ার খুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বক্তব্য দেবেন বিশাল সমাবেশে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সমকালকে বলেন, চট্টগ্রামবাসী স্বপ্নেও ভাবেনি নদীর নিচে এমন টানেল হবে। কিন্তু অসাধ্য সাধন করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। সাংহাইয়ের আদলে নদীর দুই পাড় নিয়ে তৈরি হবে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’। চট্টগ্রামের সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, টানেলের মাধ্যমে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে ১৬৮ কিলোমিটার পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভও। কক্সবাজারের মহেশখালীর ৭২টি মেগা প্রকল্পের সঙ্গে চট্টগ্রামের সংযোগও তৈরি করতে যাচ্ছে এই টানেল। পদ্মা সেতুর মতো জাতীয় অর্থনীতিতে এই টানেলও রাখতে যাচ্ছে বড় ভূমিকা।
দেশের অর্থনীতিতে কেমন ভূমিকা রাখতে পারে এই টানেল– এ প্রশ্নের জবাবে একুশে পদক পাওয়া অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থনীতি সুদৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এটি। শুরুতে টানেলে বেশি গাড়ি চলাচল করবে বলে মনে হয় না। তবে ধীরে ধীরে বাড়বে। টানেলের পরিপূর্ণ সুফল পেতে হলে মিরসরাই থেকে মেরিন ড্রাইভ নিয়ে যেতে হবে কক্সবাজার পর্যন্ত। তখন টানেল ঘিরে নদীর ওপারেও সম্প্রসারিত হবে শিল্পাঞ্চল। গড়ে উঠবে নতুন নতুন কারখানা।’ টানেলকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের মিরসরাইর জোরারগঞ্জ থেকে কক্সবাজারের শহরতলি পর্যন্ত নির্মিত হবে মেরিন ড্রাইভ। ভবিষ্যতের গুরুত্ব বিবেচনা করে মেরিন ড্রাইভটি চার এবং ছয় লেন করে করা হচ্ছে। প্রতি লেনের দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ৫ মিটার করে। জোরারগঞ্জ থেকে নগরীর পতেঙ্গা কর্ণফুলী টানেলের মুখ পর্যন্ত হচ্ছে ছয় লেন। আর টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে কক্সবাজার শহরতলি পর্যন্ত হচ্ছে চার লেন। টানেল উদ্বোধনের পর পুরোদমে শুরু হবে এই প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ।
বিশাল সমাবেশের প্রস্তুতি
টানেল উদ্বোধনকে ঘিরে স্মরণকালের বড় সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘সমাবেশে বিভাগের ১১ জেলা থেকেই আসবেন নেতাকর্মী। তবে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। মানুষের ঢল নামবে এই সমাবেশে। এ জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘উদ্বোধনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত টানেল। এখন সাজসজ্জার কাজ চলছে। মূল কাজ শেষ হয়ে গেছে আগেই।’ টানেল তৈরির এই কাজ খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বছরে গাড়ি চলবে ৬৩ লাখ
সমীক্ষা অনুযায়ী, টানেল দিয়ে বছরে প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। চালুর তিন বছর পর সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৬ লাখ। চালুর প্রথম বছরে চলাচল করা গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ হবে কনটেইনারবাহী ট্রেলার, বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও কার্ভাডভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাস এবং ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ছোট গাড়ি। তবে বিশিষ্টজন বলছেন, এই ধারণার চেয়ে বেশি গাড়ি চলতে পারে টানেলে। মিরসরাই শিল্পাঞ্চল ও মাতারবাড়ীর কর্মযজ্ঞ শুরু হলে চলাচল অনেক বেড়ে যাবে। শুরুতে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ১৭ হাজার গাড়ি চলবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
হবে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’
চীনের সাংহাই শহরের আদলে তৈরি হবে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। সিটি একটি; কিন্তু নদীর দুই তীরে দুটি টাউন। এই মর্মকথা নিয়ে টানেলের স্লোগান হলো– ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকছে। আর আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে।
উদ্বোধন হবে যেসব প্রকল্প
টানেলসহ মোট ২০ প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে টানেলসহ ১৭টি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করে উদ্বোধন করবেন। তিনটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন তিনি। আগামীকাল সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধনের পর টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে ইপিজেড মাঠে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় যোগ দেবেন তিনি। সেখানে অন্য প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরসূচিতে যে প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে– চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স, জেলা পরিষদ টাওয়ার, রাঙ্গুনিয়া ও আনোয়ারা জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, পটিয়ায় শেখ কামাল অডিটোরিয়াম কাম মাল্টিপারপাস হল, রাউজানে শেখ কামাল কমপ্লেক্স, আগ্রাবাদে সিজিএস কলোনিতে ৯টি বহুতল আবাসিক ভবন, বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল, শিকলবাহা খালের ওপর পিসি গার্ডার ব্রিজ, ডিসি পার্ক, হাজার বছরের নৌকা জাদুঘর, ১৯১টি ইউনিয়নে খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, স্মার্ট স্কুল বাস সার্ভিস ও পর্যটক বাস, রিভার ক্রুজ ও ফুল ডে ট্যুর সংবলিত পর্যটন সেবা, বার্ডস পার্ক ও চিড়িয়াখানার আধুনিকীকরণ। যেসব প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন সেগুলো হলো– চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণ, বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু টানেল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সড়ক ও সিমেন্স হোস্টেল কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ।
- বিষয় :
- খুলছে স্বপ্নের দুয়ার