আলুবীজ সংকট, দাম লাগামহীন

ফুলবাড়ীর পলিশিবনগর গ্রামের মাঠে আলুর বীজ রোপণে ব্যস্ত কয়েকজন কৃষক সমকাল
আজিজুল হক সরকার, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর)
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৬:৩৫ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ২২:৩৭
ফুলবাড়ীর পলিশিবনগর গ্রামের আশরাফুল ইসলাম দেড় একর জমিতে আলু রোপণ করছেন। গতবার ছিল সাড়ে তিন একর। বীজের দাম বেশি হওয়ায় বাকি জমিতে ভুট্টা লাগাবেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, ২৫ শতাংশ জমিতে আকারে ছোট হলে ৭৫ এবং বড় ১১০ কেজি বীজ লাগে। গত বছর ৬০ কেজির বস্তা বীজ কিনেছিলেন ১৭শ থেকে ১৮শ টাকায়। এবার তা সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি আলুবীজের দাম সরকারিভাবে ৪৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে উপজেলায় বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১১০ টাকা। বেসরকারি ও কৃষক পর্যায়ে বেড়েছে দাম। ফলে ভরা মৌসুমে বীজের তীব্র সংকট এবং মূল্যবৃদ্ধিতে চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন আশরাফুলের মতো অনেক কৃষক।
এর আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে আলুবীজ বিক্রি করলেও এবার ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি করছে। এর কম হলে খাদ্য হিসেবে বাজারে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বাজারে রান্নায় ব্যবহারের আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি। এসব কারণে এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নাও হতে পারে বলে আশঙ্কা উৎপাদনকারীদের।
বিএডিসি ২০২১-২২ অর্থবছরে আলুবীজের দাম নির্ধারণ করে কেজিপ্রতি ২২ থেকে ৩২ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩১ থেকে ৩৯ টাকা ছিল। তবে বেসরকারিভাবে বিএডিসির চেয়ে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা দাম বেশি বলে জানান মহেশপুর গ্রামের চাষি আব্দুল মান্নান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় এক হাজার ৯৯৪ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে নতুন আলুর চাহিদা থাকায় উঁচু জমিতে ৫০ থেকে ৫৫ দিনে উত্তোলনযোগ্য হাইব্রিড আগাম জাতের বীজ বপন করছেন অনেক চাষি।
দিনাজপুর কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলায় চাহিদার মাত্র চার শতাংশ সরকারি আলুবীজ বরাদ্দ এসেছে। নশিপুর হিমাগারের ধারণ ক্ষমতা এক হাজার ১০০ টন। সংকট কাটাতে সিংহভাগ বীজ আনতে হবে অন্য জেলা থেকে। এতে খরচ বাড়বে। ৪৫ হাজার ৫০০ হেক্টরে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১০ হাজার হেক্টরে আগাম চাষ হয়।
এ জন্য ৭৫ হাজার ৭৫ টন বীজ প্রয়োজন। বরাদ্দ আছে তিন হাজার ৮৬ টন, যা চাহিদার চার শতাংশ। জাতভেদে কেজিপ্রতি বীজের দাম বাড়ানো হয়েছে ২০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২৪ টাকা পর্যন্ত। বিএডিসি জেলায় বরাদ্দ দেয়। ফুলবাড়ীতে সেভাবে বরাদ্দ আসেনি বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে।
ফুলবাড়ী কোল্ডস্টোরেজে সাত হাজার ১৫০ টন আলু মজুত ছিল বলে জানান সুপারভাইজার মোজাম্মেল হক। তিন হাজার ৯২৬ টন বিক্রি হয়েছে। তাঁর তথ্য অনুযায়ী, এ কোল্ডস্টোরেজে ফুলবাড়ীসহ পার্বতীপুর, চিরিরবন্দর, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর ও হাকিমপুরের কৃষকদের তিন হাজার ২২৪ টন বীজ ছিল, যা রোপণের কাজ চলছে। এটি প্রয়োজনের তুলনায় কম।
জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে উপজেলায় এক হাজার ৯১৯ হেক্টর জমিতে ৪৫ হাজার ৯৯৬ টন আলু উৎপাদন হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে এক হাজার ৭৭০ হেক্টরে উৎপাদন হয়েছে ৪১ হাজার ৫৯৫ টন। ২০২১-২২ এর তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিন হাজার ৫০১ টন কম উৎপাদন হওয়ায় বাজারে প্রভাব পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে আলুর দাম কমে। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরিষা বেশি চাষ করেন কৃষকরা।
কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক জমি অনাবাদি পড়ে আছে। এসব জমিতে ভুট্টা চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান কৃষক জহুরুল ইসলাম, সিদ্দিকুর রহমান ও গোলাপ হোসেন। ১০ দিন আগে জয়পুরহাট থেকে ১২০ কেজি বীজ ৬ হাজার টাকায় কিনেছেন খয়েরবাড়ীর বিপদ চন্দ্র। আনতে খরচ ৯০০ টাকা। এখন দাম আরও বেশি।
এলাকার লিটন কুমার দাস ও সঞ্জয় কুমার দাস এক বিঘা জমিতে আলু লাগাবেন। গত বার লাগিয়েছিলেন দুই বিঘায়। আনোয়ার হোসেন ২০ শতাংশ জমিতে আলু লাগাবেন। গতবার ছিল এক বিঘা। বেতদিঘির ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) শাহ আব্দুল কুদ্দুস ও এলুয়াড়ীর চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নবিউল ইসলাম বলেন, আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বীজের দামও বাড়ছে। সরকার বীজ সরবরাহ করলে উৎসাহিত হতেন কৃষক।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুম্মান আক্তার বলেন, আলুবীজের দাম বেশি হলেও দাম ভালো পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। ভুট্টার সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে আলু চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
ইউএনও মীর আল কামাহ তমাল বলেন, খাবার আলু নিয়ে বাজারে তদারকি চলছে। বীজের বিষয়টিও দেখা হবে। জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মমতাজ বেগম বলেন, বিএডিসি যদি বলে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে আলুবীজ বিক্রি হচ্ছে, তারা বাজার তদারকির চিঠি দিলে সহায়তা করা হবে।