ঢাকা বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩

গহনা বিক্রিতে মন্দা, পেশা বদল

গহনা বিক্রিতে মন্দা, পেশা বদল

তাড়াশ পৌর বাজারে গহনা তৈরি করছেন এক কারিগর -সমকাল

 এম আতিকুল ইসলাম বুলবুল, তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ)

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৭:১৯ | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ২৩:১৯

তাড়াশ সদর বাজারে মো. শহিদুল ইসলামের (৬২) প্রায় ৪০ বছর ধরে অলংকার ব্যবসা রয়েছে। 

এক যুগ আগেও রমরমা ব্যবসা করেছেন তিনি। তবে প্রতিষ্ঠানটি এখন ধুকছে। ২০১২ সালে অন্তত ১০ জন কারিগর স্বর্ণালংকার তৈরি করতেন। এখন আছেন মাত্র তিনজন। আগে বছরে খরচ বাদে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা আয় হতো। বর্তমানে বছরে ৪ লাখ টাকার ব্যবসাও হয় না। সোনা ও রুপার দামে অস্থিরতার কারণে ব্যবসা লাটে উঠেছে বলে জানান এ ব্যবসায়ী।

অথচ চলনবিল অঞ্চলের ফসল উৎপাদন মৌসুমের সঙ্গে অলংকার ব্যবসার শত বছর ধরে সমৃদ্ধ সম্পর্ক রয়েছে। কয়েক বছরে তিন শতাধিক কারিগর ও ব্যবসায়ী মন্দার কারণে এ পেশা ছেড়েছেন। এমন তথ্য জানিয়ে ব্যবসায়ী মো. শহিদুল ইসলাম জানান, এলাকার চাটমোহর, হান্ডিয়াল, গুরুদাসপুর, ভাঙ্গুড়া, উল্লাপাড়া, সিংড়া, রায়গঞ্জ, আত্রাই, তাড়াশসহ বিভিন্ন বাজারে স্থানীয় কারিগরদের তৈরি স্বর্ণালংকার প্রসিদ্ধ ছিল। বোরো ও আমন ধান ওঠার পর গহনা তৈরির কাজ বেড়ে যেত।

কৃষিতে সমৃদ্ধ চলনবিল এলাকায় দুই মৌসুমে বিয়ে, সুন্নতে খতনা, অন্নপ্রাসনসহ নানা সামাজিক আয়োজন বেশি হয়। এতে উপহার দিতে কৃষক পরিবারগুলো সোনা ও রুপার অলংকার তৈরি করেন। কিন্তু সাত থেকে আট বছর ধরে আমন কিংবা বোরো ধানের সময়ে কৃষকরা স্বর্ণালংকার তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের গহনা তৈরির সামর্থ্য কমায় আগের চার ভাগের তিন ভাগ অলংকার ব্যবসাও এখন নেই বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

১৯৯৬ সালে স্ত্রীকে ২০ হাজার টাকায় দুই ভরি ওজনের সোনা দিয়ে হাতের বালা, নাকের ফুল, কানের দুলসহ বিভিন্ন ধরনের গহনা তৈরি করে দিয়েছিলেন তাড়াশের সেরাজপুর গ্রামের কৃষক শফিউল হক বাবলু। সংসার জীবনের ২৭ বছর পর মেয়ের বিয়েতে এখনও স্বর্ণালংকার দিতে পারেননি। তিনি বলেন, এক ভরি সোনার গহনা তৈরিতে কারিগরের মজুরিসহ প্রায় ১ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এত টাকায় কেনার সামর্থ্য এখন নেই। তাঁর ভাষ্য, এ অবস্থা চলনবিল অঞ্চলের বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সোনা ও রুপার দাম বেড়েই চলেছে। প্রকারভেদে গিনি সোনা ৮০ হাজার ও চকলেট সোনা ৯৩ হাজার টাকা ভরি বিক্রি হচ্ছে। দুই দশক আগে গিনির ভরি ১৫ থেকে ২০ আর চকলেট ২৫ থেকে ২৮ হাজার টাকা ছিল। রুপার দাম প্রতি ভরি ১২শ থেকে সাড়ে ১২শ টাকা। দুই দশক আগে ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ভরি।

কৃষক পরিবারগুলোয় অলংকার হিসেবে সোনা ও রুপার তৈরি হাতের বালা, চেইন, কানের দুল, মাকরি, নাক ফুল, গলার হার, আংটি, ব্রেসলেট ও নূপুরের চাহিদা বেশি। এখন সিটিগোল্ড জাতীয় রেডিমেইড অলংকারে গৃহিণী ও তরুণীদের আগ্রহ বেড়েছে। ফলে সোনা ও রুপার অলংকারের ব্যবসায় এখন ভাটা দেখা দিয়েছে।

শুধু সোনা বা রুপা নয়, পাঁচ থেকে সাত বছরের ব্যবধানে বেড়েছে গহনা তৈরির অন্য উপকরণের দামও। তাড়াশের জুয়েলারি ব্যবসায়ী পলান সরকার জানান, অলংকার তৈরিতে ব্যবহৃত ৭০০ টাকার এসিডের জার এখন ৩ হাজার ২০০ টাকা। অলংকার পরিষ্কারের ৫০ টাকার রিটা এখন ৫০০ টাকা কেজি। ২০০ টাকা কেজি কেনা সোডা এখন ১ হাজার ৬০০ টাকা। ৭০০ টাকার চাঁচ ৪ হাজার টাকা।

কারিগরদের মজুরিও বেড়েছে পাঁচ থেকে ছয় গুণ। এসব কারণে কাজ কমেছে। জানা গেছে, কোনো ক্রেতা এক ভরি ওজনের মধ্যে গহনা তৈরি করলে কারিগরদের মজুরি দিতে হয় প্রায় ৬ হাজার টাকা। এক যুগ আগে ১ হাজার টাকায় হয়ে যেত।

ব্যবসা সংকুচিত হয়ে পড়ায় চলনবিল পাড়ের তিন শতাধিক ব্যবসায়ী এবং কারিগর পেশা ছেড়েছেন বলে জানান ভাঙ্গুড়ার কারিগর প্রদীপ কুমার। তাঁর ভাষ্য, দোকানে আগের মতো কাজ নেই। অলস সময় কাটাতে হয়। মাস শেষে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা উপার্জন হলেও তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর মতো অনেক কারিগর অন্য কাজ করছেন।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সোনা, রুপাসহ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার এ অবস্থা জানিয়ে তাড়াশ উপজেলা জুয়েলারি সমিতির সভাপতি মজিবুর রহমান বলেন, এক সময় মধ্য ও উচ্চবিত্ত কৃষক পরিবারের একজন স্বজনের বিয়েতে চার-পাঁচ ভরির স্বর্ণালংকারও তৈরি করেছেন। এখন ধানের দাম না পেয়ে কিংবা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংসার চালানোর পর সঞ্চয় না থাকায় স্বর্ণালংকার তৈরির সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছেন তারা।

আরও পড়ুন