গ্রামটি এখন হাঁস হ্যাচারিপল্লি

নিজের হ্যাচারিতে ফুটানো বাচ্চার পরিচর্যা করছেন ইয়াছিন মিয়া সমকাল
মোতাহার আলম চৌধুরী, মদন (নেত্রকোনা)
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮:৩৭ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:৩৭
প্রাকৃতিক উপায়ে হাঁসের ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন ইয়াছিন মিয়া। তাঁর হাত ধরে বহু নারী-পুরুষ এখন ডিম ফোটানোর কাজ করছেন। ইয়াছিন মিয়ার বাড়ি মদন উপজেলার তিয়শ্রী ইউনিয়নের কোঠুরীকোনা গ্রামে। তুষ ও হারিকেনের আলোতে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজে নিয়োজিত এ গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবার। গ্রামটি এখন হাঁস হ্যাচারিপল্লি নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
করোনা মহামারির কারণে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজে কিছুদিন ধস নেমেছিল। এলাকার বাইরে বাচ্চা বিক্রি করতে পারেননি। করোনার ধাক্কা সামলে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন হ্যাচারি মালিকরা। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্রেতা ভিড় করছেন হ্যাচারিপল্লিতে। প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই হ্যাচারিপল্লির লোকজন। অনলাইনে অর্ডার করলেই নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে যায় হাঁসের বাচ্চা।
প্রাকৃতিক উপায়ে মুরগি ডিমে তাপ দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। সেখান থেকেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ডিম ফোটানোর যন্ত্র ইনকিউবেটরের আবিষ্কার। ব্যবসার জন্য একসঙ্গে অধিক পরিমাণে ডিম ফোটানোর ক্ষেত্রে ইনকিউবেটরের বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ। কিন্তু কোঠুরীকোনা হ্যাচারিপল্লি হাওরাঞ্চলে হওয়ায় বিদ্যুৎবিভ্রাট লেগেই থাকে। তা ছাড়া অনেকের এই যন্ত্র কেনার সামর্থ্য নেই। তাই তুষ ও হারিকেনের আলোতে হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন তারা।
প্রথমে ভালো জাতের হাঁসের ডিম সংগ্রহ করেন হ্যাচারি মালিকরা। সেগুলো পানিতে পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। এর পর বাছাই করা ডিম মাটি বা ইটের তৈরি পাকা ঘরের মধ্যে বাঁশের মাচায় সারিবদ্ধভাবে রেখে তোশক বা মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। মাচার নিচে হারিকেন বসিয়ে পরিমাণমতো তাপ দেওয়া হয়। ২৫ দিন পর ডিমগুলো ফুটতে শুরু করলে কাপড়ের আবরণ তুলে নেওয়া হয়। ২৮ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। এক দিন বয়সের প্রতিটি হাঁসের বাচ্চা ২০-৩০ টাকায় বিক্রি হয়।
এক সময় কোঠুরীকোনা গ্রামের লোকজন কাজের সন্ধানে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতেন। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটত পরিবারগুলোর। ১৯৯০ সালের দিকে ইয়াছিন মিয়ার ভাই হাদিস মিয়া প্রথমে নিজ বাড়িতে তুষ ও হারিকেনের আলোক পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজ শুরু করেন। পরে একই পদ্ধতি গ্রহণ করে গ্রামের শতাধিক পরিবার।
ইয়াছিন মিয়া বলেন, ‘১৯৯০ সালে প্রথম তুষ ও হারিকেনের আলোক পদ্ধতিতে ২ হাজার হাঁসের ডিম দিয়ে বাচ্চা ফোটানোর এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন আমার বড় ভাই হাদিস মিয়া। এক দিন বয়সের বাচ্চাগুলো স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রি করেন। ১৫-২০ দিনের মধ্যে ভাইয়ের সফলতা দেখি। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে আমিও একই কাজে জড়িয়ে যাই। ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পাই। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত নিজ উপজেলায় ১ হাজার ৪০০ এবং ভারতের মেঘালয়ে ৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘এক সময় আমার কিছুই ছিল না। এ পেশায় থেকে ছেলেদের লেখাপড়া করিয়েছি। জমি কিনে কোটি টাকা ব্যয়ে ভবন নির্মাণ করেছি। জমি কিনেছি।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তাইরান ইকবাল জানান, কোঠুরীকোনা গ্রামে দেড় শতাধিক পরিবার হাঁস হ্যাচারি শিল্পে জড়িত। ইয়াছিন মিয়াসহ সবাই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। প্রায়ই হ্যাচারিগুলো পরিদর্শন করে হাঁসের রোগ প্রতিরোধের টিকা দিয়ে যাচ্ছেন তারা।