আলোচিত বরিশাল-৪ আসন
পঙ্কজ ও শাম্মীর মুখ দেখাদেখিও বন্ধ
পঙ্কজ নাথ, ড. শাম্মী আহমেদ
সুমন চৌধুরী, বরিশাল
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:৩৬
জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠছে বরিশাল-৪ আসনের আওয়ামী লীগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নেতার মধ্যে। গত ১৪ নভেম্বর সারাদেশে অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মধ্যে মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা উপজেলার কয়েকটি প্রকল্প ছিল। এ উপলক্ষে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অনুষ্ঠানে অন্যতম আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ। কিন্তু সেখানে সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ থাকায় ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করে হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অবস্থান করেন তিনি। একইভাবে গত ৩০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার মডেল মসজিদ উদ্বোধনে উপজেলা প্রশাসনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ড. শাম্মী ছিলেন শ্রীপুর ইউনিয়নে দলের কর্মিসভায়।
নেতাকর্মী জানান, পঙ্কজ নাথ কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলে সেখানে যান না শাম্মী ও তাঁর অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। আবার এ দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণই করা হয় না পঙ্কজকে।
বরিশাল-৪ (মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা) আসনে আওয়ামী লীগে বিভক্তির রাজনীতিতে শীর্ষ নেতারা এভাবে একে অপরকে এড়িয়ে চলেন। কেউ কারও মুখ দেখতে নারাজ। প্রায় এক দশক এ অবস্থা চলছে। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পঙ্কজ নাথ ও ড. শাম্মী দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। দু’জনই অনুসারীদের নিয়ে মাঠে সরব। সভা-সমাবেশে প্রতিপক্ষের উদ্দেশে শীর্ষ নেতাদের আক্রমণাত্মক বক্তৃতায় তপশিল ঘোষণার আগে থেকেই এ আসনে নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়েছে। সমর্থকরাও নিজ নিজ নেতার পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব ও মারমুখী অবস্থানে।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পঙ্কজ নাথ ২০১৪ সাল থেকে টানা দুই মেয়াদ এ আসনের এমপি। ২০১৬ সালে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের সঙ্গে তিনি প্রকাশ্যে বিরোধে জড়ান। ধারাবাহিক সংঘর্ষ-হানাহানিতে কমপক্ষে ১০ জনের প্রাণ গেছে। এর জেরে গত সেপ্টেম্বরে দলীয় পদ হারান। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ১৯৭০, ১৯৭৩ ও ১৯৯১ সালে নির্বাচিত এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের মেয়ে ড. শাম্মী আহমেদ। তিনি কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেও এলাকায় নির্বাচনমুখী যাতায়াত শুরু করেন ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর। ওইদিন পঙ্কজবিরোধীদের নেতৃত্বে বড় শোডাউন করে মেহেন্দীগঞ্জে গেলে তাঁর প্রার্থিতার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
দলীয় পদ হারিয়ে পঙ্কজ চাপের মুখে পড়লে ড. শাম্মী সংসদীয় আসনের তিনটি সাংগঠনিক কমিটি নিজের মতো করে গঠন করেন। তাঁর ছোট ভাই সাহাব আহমেদকে করেন মেহেন্দীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাদের নিয়েই ইউনিয়নগুলোতে সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন তিনি। অন্যদিকে পঙ্কজ গ্রামে-গঞ্জের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অনুষ্ঠানে বড় শোডাউন করে জনপ্রিয়তার জানান দিচ্ছেন।
বিরোধের নেপথ্যে
মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলায় আওয়ামী লীগে বিরোধের বিষয়ে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই সংঘাতের মূল উৎস। পঙ্কজবিরোধীদের অভিযোগ, তিনি ত্যাগী ও প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের মূল্যায়ন করেননি। বরং হামলা-নির্যাতন ও মামলার শিকার হয়েছেন।
অন্যদিকে পঙ্কজ সমর্থকদের দাবি, হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জে কয়েকজন শীর্ষ নেতা স্বাধীনতার পর থেকে দলকে ক্ষমতায় চাইলেও এমপি চান বিরোধী দলের। বিরোধী দলের এমপিকে চাপের মুখে রেখে উপজেলার আর্থিক বিষয়গুলো (মেঘনার মাছঘাট, বালু, চর ও উন্নয়ন প্রকল্প) নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তারা। ওই চক্রটির ষড়যন্ত্রেই ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এর নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হেরেছে। ২০১৪ সালে পঙ্কজ নাথ এমপি হলে চক্রটির বিরোধিতার মুখে পড়েন। এক পর্যায়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় জেলা আওয়ামী লীগ।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম ভুলু বলেন, পঙ্কজ নাথ কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিলে মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলা উপজেলা ও কাজীরহাট থানা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী সেখানে যান না।
ড. শাম্মীর কট্টর সমর্থক উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন খান বলেন, পঙ্কজকে মনোনয়ন দেওয়া হলে দলের পদধারীরা মাঠে নামলেও সাধারণ নেতাকর্মী থাকবেন না। একই ধরনের বক্তব্য দেন শাম্মীর আরেক সমর্থক হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুলতান মাহমুদ টিপু সিকদার।
পঙ্কজ নাথ তাঁর বিরোধিতা প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, পঁচাত্তর ট্র্যাজেডির পর যারা বঙ্গবন্ধুর ছবি ভেঙে উল্লাস করেছিল, তারাই মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের যদি এতই ক্যারিশমা থাকত, তাহলে ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০১, এমনকি ২০০৮-এ সারাদেশে নৌকার গণজোয়ারের সময়েও বরিশাল-৪ আসনে হেরেছে কেন? তাঁর মতে, প্রার্থী যেই হোক বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুরকারী চক্রটির সঙ্গে না থাকা নৌকার জন্য মঙ্গল হবে।
এ প্রসঙ্গে ড. শাম্মী আহমেদ বলেন, নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে আমাকে এবং আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাদের আমন্ত্রণ করা হয় না। তা ছাড়া এমপি পঙ্কজ নাথ তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ওইসব অনুষ্ঠানে দখলদারীর ভূমিকায় থাকেন। যে কারণে এসব অনুষ্ঠানে আমরা যাই না।
তিনি বলেন, তাঁর মরহুম বাবা মহিউদ্দিন আহমেদের পঁচাত্তর-পরবর্তী বিষয় নিয়ে পঙ্কজ নাথ যেসব মিথ্যাচার করেন, এ নিয়ে কথা বলতেও তাঁর রুচিতে বাধে। মহিউদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিছু সন্ত্রাসী ছাড়া পঙ্কজের সঙ্গে মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা উপজেলা ও কাজীরহাট থানা আওয়ামী লীগের কেউ নেই।